এ কে এম জাবেরঃ দূর্যোগের পর হাঁসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। এবছর হাওর জুড়ে ধান আর ধান। বাম্পার ফলন হয়েছে বোরো ধানের। তারপরও আনন্দের মধ্যে উদ্বিগ্নতা চাষীদের। পুরো ধান গোলায় উঠানো নিয়ে যত দুশ্চিন্তা তাদের। কৃষকের ভয় গেল বছরের মত যদি আবারো গ্রাস করে বন্যা। হাকালুকি, কাউয়াদিঘি আর হাইল হাওর।
মৌলভীবাজার জেলার তিনটি হাওরের দৃষ্টি জুড়ে দোল খাচ্ছে বোরো ধান। বোরো ধানের দোলনীতে যেন কৃষকের স্বপ্ন দোলছে। বাদ যায়নি মনু, ধলাই, ফানাই ও জুড়ী নদীর তীরবর্তী এলাকার জমিও। ওই এলাকায় পাকা ও আধপাকা সোনালী ফসল বোরো ধান মন কাড়ছে সকলের। এজেলার হাওর ও নদী তীরের চাষীরা এখন বোরো ধান নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চলছে ধান কাটা ও মাড়াই। গেল বছরের দূর্যোগের পর এমন দৃশ্যে চাষীরা আনন্দিত। এমন স্বপ্ন প্রত্যাশায় উদ্বেলিত কৃষককূল। ইতিমধ্যে বিআর ২৮ ও বিআর ২৯ জাতের ধান পাকতে শুরু করেছে।
কৃষকরা জানানেল জমিতে শতকরা ৭০-৭৫ ভাগ ধান পাকলেই ঝুঁকিমুক্ত থাকতে তা কেটে ফেলছেন। কাঁচা আর আধপাঁকা ধান ঘরে তোলা নিয়ে তারা উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রয়েছেন। এখন আকাশে মেঘের আভা আর বিজলী চমকাতে দেখলেই তাদের যত দুশ্চিন্তা। কারন গেল বছর চৈত্রের আগাম বন্যায় তাদের স্বপ্নের সোনালী ফসল বোরোসহ সহায় সম্বল হারিয়ে ছিলেন।
সেই দু:স্ব যন্ত্রনার স্মৃতি এখনো তাদের তাড়া করে। এজেলার হাওর ও নদী তীরের বাসিন্দাদের জীবীকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বোরো ধান চাষাবাদ। সাথে সহায়ক হিসেবে আছে মাছ ধরা। কিন্তু মাছ ধরাতে নানা বিধি নিষেধ থাকায় ওই পেশা তাদের তেমন একটা অনুকূলে নয়। তাই বছর জুড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে খাওয়া বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে বোরো ধান। তাই জীবন জীবীকা নিয়ে তাদের স্বপ্ন প্রত্যাশা এই বোরো ধানকেই ঘিরে।
সরজমিনে হাকালুকি হাওরের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা অংশে গেলে চোখে পড়ে বোরো ধান কাটার দৃশ্য। ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে রাত দিন ব্যস্ত চাষীরা। হাওর পাড়েই কাটা বোরো ধান মেশিন দিয়ে মাড়াই করা হচ্ছে। সেই ধান রোদে শুকানোর পর তা গোলায় রাখা হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায় এবছর জেলা জুড়ে আবাদকৃত বোরো ধানের মধ্যে বিআর-২৮, ৬০ ভাগ ও বিআর-২৯, ৪০ ভাগ দ্রুত উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিড) জাতীয় দান রোপন হয়েছে। এবার বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ছিল ৫২ হাজার ৪৭১ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৫৪.১২ হেক্টর। এর মধ্যে হাওর এলাকায় ১৯ হাজার ৩ শত ৬৬ হেক্টর ধান চাষ হয়েছে।
কৃষি বিভাগের পরামর্শ দূর্যোগের কবল থেকে নিরাপদ থাকতে প্রতিটি ধানের ছড়ায় ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলে তা দ্রুত কাটার। হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের বোরো চাষী কামাল মিয়া (৫৫), আছর উল্লাহ (৭৫), রমিজ মিয়া (৫০),জমির আলী (৬০),কলিম মিয়া (৬৫), সৌরভ দাস (৪৫), সুলেমান আলী, জুড়ীর জায়ফরনগর ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়া (৩৮),মানিক মিয়া (৪৫),দলা মিয়া (৫০), রুমি বেগম (২৪),সুলতানা বেগম (৪০), বানেছা বেগম (৪৮) সহ অনেকেই জানান এবছর বোরো ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু পুরো ধান ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা। আকাশে মেঘের গর্জন দেখলেই তাদের ভয় হয়। যদি গেল বছরের মত সব কেড়ে নেই অকাল বন্যা। তারা জানালেন তাদের এলাকায় গেল প্রায় ১০-১২ দিন থেকে পাকা আধপাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে।
রাত দিন বোরো ধান কাটা মাড়াই ও ঘরে তোলা নিয়ে কৃষাণ-কৃষাণীদের ফুরসদ নেই। নতুন ধান ঘরে তোলতে পেরে হাঁসি ফুটেছে হাওর তীরের কৃষিজীবী মানুষের। তবে কৃষকরা জানান এবছর ব্লাষ্ট ও নেক ব্লাষ্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারনে অর্ধেক ধানই (চুচা) চাল হীন। এছাড়াও ধানের থোড় বের হওয়ার পরপরই বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকের ধারনা গেল বছর বন্যার কারনে পলি আসায় মাটি অত্যধিক উর্বর হওয়াতে ধান (চুচা) চালহীন হয়েছে। তাছাড়া এখনো বোরো ধানের জমি গুলোতে পানি থাকায় প্রচুর পরিমান জোঁক হওয়ায় ধান কাটতে কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া এই সময়ে ধান কাটা মাড়াই ও গোলায় তোলার জন্য মিলছেনা পর্যাপ্ত পরিমান শ্রমিক। তারপরও আরো ১২-১৫ দিনের মধ্যে হাওরে ধান কাটা শেষ হবে বলে তারা ধারনা করছেন। জানা গেল ওই চাষীদের মধ্যে কেউ ২৫ বিঘা,কেউ ৩০ বিঘা, ১০ বিঘা, কেউ ৮বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। আবার অনেকেই নিজের জমিজমা না থাকায় বর্গা নিয়েও করেছেন বোরো চাষ। বিঘা প্রতি ৪-৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। যা গত বছরের চাইতে এবছর বিঘা প্রতি খরছ কম হয়েছে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা। তবে এবছর কি পরিমান আয় হবে এমন প্রশ্নে তারা বলছেন পুরো ধান ঘরে না উঠলে আয় ব্যয়ের হিসাব করা যাচ্ছেনা। তবে তাদের ধারনা উৎপাদন ভালো হওয়াতে এবছর ব্যয়ের পরও লাভ হবে। আর গেল বছরের ক্ষতিও অনেকটাই পোষাবে।
গতকাল দুপুরে সরেজমিন হাকালুকি হাওর পাড়ের কুলাউড়ার কাড়েরা, কানেহাত, কালেশার, ছকাপন, বড়ধল, বাদেভুকশিমইল, কুরবানপুর, শাহাপুর, গৌড়করণ, মুক্তাজিপুর ও জুড়ি উপজেলার জায়ফরনগর ও পশ্চিম জুড়ি, বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়ের কয়েকটি এলাকার ঘুরে দেখা গেল প্রচন্ড রোদের মধ্যেও পাকা আধপাকা বোরো ধান আনন্দ উৎসব করেই কাটছেন কৃষকরা। নতুন ধানের খড় ও কুড়া (গুড়া) গরু,মহিষ ও হাঁস মোরগের খাদ্য হচ্ছে। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে পুরো এলাকা জুড়েই উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। গেল বছরের বেদনা আর সব হারানোর দু:স্ব স্মৃতি ভুলে এখন তারা উজ্জীবিত। ঘরে নতুন ধান তোলতে পেরে যেন প্রাণ ফিরেছে তাদের। এমন দৃশ্য জেলার আনান্য হাওর ও নদী তীরবর্তী এলাকারও।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো: শাহজান বলেন এবছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। পাকা ধান কাটাও চলছে। তবে অনেক স্থানে বোরো ধান ব্লাষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তাই আগামী বছর জাতে এ রোগে আক্রান্ত না করতে পারে সে জন্য এই রোগাক্রান্ত ধান থেকে বীজ না রাখার পরামর্শ কৃষি বিভাগের। তবে বাধ্য হয়ে এই ধান থেকে বীজ রাখলে তা বপনের আগে ছত্রাক নাশক ঔষদের মাধ্যমে শোধন করে নিতে হবে। জেলা কৃষি বিভাগের দাবি এবছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। পুরো ধান ঘরে উঠলে এর সুফলতা মিলবে।

