ডা. সাঈদ এনাম: ক'দিন
থেকে মাথায় একটা পোকা ঢুকেছে। কিচমিচ করছে, কিন্তু বেরুচ্ছেনা, বের হতে
চাইছেনা, বা বের হতে পারছেনা। পোকাটি হলো বংশের বাত্তি টির শেষ পর্ব লেখার।
ভাবলাম আজকে কাহিনীর মুল নায়িকা পিংকির সর্বশেষ অবস্থাটা লিখে লেখাটার ইতি
টানি। ইতিতো টানতে হবে। ডাক্তার দের পেইজ প্ল্যাটফর্ম এটি দিয়েছিলাম।
জয়নুল আবেদীন টিটু ভাই'র পাল্লায় পড়ে প্ল্যাটফর্ম এ দেই। প্রথমে তিনি
লেখাটি পড়েন, পরে বললেন ভালো হয়েছে, প্ল্যাটফর্ম দিতে পারেন। আমি দিতে
চাইনি। সবাই ডাক্তার। শিক্ষিত পাঠক। কেমন নিবে। পরে দিই সাহস করে। পড়েন
কিছু কিছু পাঠক। মন্তব্য ও দেন। সেখানের কিছু পাঠক অপেক্ষা করছে, শেষমেশ কি
হলো মেয়েটির। সবাই তার প্রতি সহানুভূতিশীল। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ মানুষের
প্রতি সহানুভূতিশীল হবেই। হওয়া উচিৎ। অতটুকুন একটা মেয়ে। বয়স আর কতইবা হবে
অথচ কি সুনামি বয়ে যাচ্ছে তার ছোট জীবনে।
সকালে
সে অজ্ঞান হয়ে একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়। অজ্ঞান হবার কারনটা আপাতত বুঝা
গেছে। দুপুরে আমার অফিসে তার ননদের স্বামী এসেছিলেন। মতলুব না কি যেন নাম।
আপাদমস্তক সাদা পোশাক, । হাতের দশটি আংগুলের প্রায় সবগুলোতেই আংটি ছিলো।
লোকটি আংটি তে বিশ্বাস করে মনে হলো। আমি অনেক লোক দেখেছি যাদের আংটি ততে
অগাধ বিশ্বাস। তাদের ধারনা আংটি তাদের সকল শনি আর রাহুর গ্রাস থেকে রক্ষা
করবে। বাজারে হাজার রকমের আংটি পাওয়া যায়।
আমাদের
দেশে আংটির ব্যবসাটি অত্যন্ত জমজমাট। একেকটা আংটির দাম হাজার থেকে লাখ
টাকাও হয়। প্রয়োজন বা বিপদ বুঝে দাম। কাউকে বশ করতে যে আংটি তার এক রকম
দাম, আবার কাউকে গ্রাস করতে যে আংটি তার আরেক রকম দাম। সাধারণত গ্রাস করন
আংটি গুলোর দাম বেশি। আংটি শিক্ষিত লোকেরা তেমন একটা পরে না। পরলেও, তবে দশ
পনেরোটা না। শখের বশে নেহায়েত একটা। সৌন্দর্যের জন্য তারা পরে থাকেন। কিছু
এনজাইটি ডিসওর্ডার এর রোগী দের দু একটা আংটি পরতে দেখা যায়।
আমার
একটা আংটি আছে। রোপার, সাথে আকিক না কি যেনো এক পাথর। আমি তেমন পরিনা।
সমস্যা হয় লিখতে। ডাক্তার দের প্রচুর লেখতে হয়। আমার আম্মা বলেন আংটি পরে
কি হবে। খামাখা ওজু নামাজ হয়না। তুলে রাখ। নামাজে দাড়ালে আল্লাহ যদি
বলেন....
"ওরে বান্দা তোর যদি আংটি আর তাবিজেই এতো বিশ্বাস তবে আর আমি তোকে আর কি ভাবে উদ্ধার করবো"
হাতে
পায়ে দশ পনেরো টা আংটি, বশী করন বা গ্রাসীকরন আংটি সাধারণত খারাপ বা
স্মাগলার টাইপের লোকেরা পরে। এই যেমন ব্যাংক থেকে কোটি টাকা হাপিস করে
দিয়েছে কিংবা স্বাক্ষর জালিয়াতি করে কারো কোটি টাকার সম্পত্তি গাপুস করে
দিয়েছে। এখন তার পিছনে দুর্নীতি দমনে মামলা হয়েছে। সে এখন দৌড়ের উপর।
কিছুতেই মামলার জাল থেকে বেরুতে পারছেনা। কৃষকের কারেন্ট জালে যেমন মাছ
আটকে যায় তেমন। তাই এখন সে চাচ্ছে শনি এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের সব কটা কে
ধরুক। ব্যাটা পক্ষাঘাত হয়ে মরে যাক সব। তাই দশ বারোটা গ্রাসী করন আংটি।
একটায় কাজ না করলে আরেকটা। অনেক সময় বাইপোলার মেনিক ডিসওর্ডার এর রোগী রা ও
আংটি পরে, অনেক অনেক আংটি, পিতলের মালা, বড় বড় রঙ বেরঙ এর লোহার চুড়ি সেই
সাথে লাল কালো ঝমকালো পোশাক পরতে দেখা যায় তাদের।
একবার
আমার এক লোকের সাথে পরিচয় হয়। লোকটি মেনিক পার্সোনেলিটির। মুখে সামান্য
দাড়ি, মাথায় টুপি। সৎ সাজার চেষ্টা। দেখতে কিছুটা হুজুরদের মতো। কিন্তু
গলার স্বর হুজুর দের মতো সুরেলা চিকন না। হুজুর দের ওয়াজ করতে হয়। বয়ানের
মাধ্যমে মানুষ দের মাথায় ভালো জিনিশ ঢুকিয়ে দিতে হয় তাই তাদের কন্ঠ সুরেলা
মিহি বা চিকন হতে হয়, যাতে মানুষ মোহিত হয়ে শুনে। একবার সিলেট থেকে ঢাকা
যাচ্ছি বাসে, ড্রাইভার দিলো লাগিয়ে জনপ্রিয় এক হুজুরের বয়ান। বয়ানের বিষয়
বস্তু ছিলো কবরের আজাব। ব্যাস, আর আর যাই কই আমি সহ বাসের সকল কাঁদছে আর
চুপে চুপে চোখের জ্বল মুচছে। হিন্দু মুসলিম সব। চোখের জ্বল মুছতে মুছতে আমি
ডা. ফজলে রাব্বি মেডিকেল হোস্টেলে ঢুকছি, এমনি এক বন্ধু জড়িয়ে ধরে বললো,
কি ব্যাপার দোস্ত কাঁদছিস ক্যা?। আমি চোখের জ্বল মুছতে মুছতে বললাম,
"আমি পাপীর কি হবেরে কবরে...."!
সে
যাইহোক, এই লোকটি বেশ বুশায় ভালো মানুষ বা হুজুর হুজুর ভাব নিলেও গলার
স্বর হুজুরদের মতো ছিলোনা। স্বর টা একটু ভড়াট, ঘাউ ঘাউ টাইপের। লোকটি ঘুমের
সমস্যা নিয়ে এসেছিলো। তার আংগুলে একটা আংটি দেখিয়ে বলেছিলো ঘুমের জন্য এই
আংটি টি কিনেছি। দাম এক লাখ এক টাকা এক পয়াসা । এক পয়সা দিতে যেয়ে মারাত্মক
সমস্যায় পড়েছিললো। পরে যেখান থেকে আংটি কিনে সেখান থেকে নাকি পাকিস্তান
আমলের লাল একটা এক পয়সার কয়েন অতিরিক্ত এক হাজার দিয়ে কিনেছিল। আমি অবাক
হলাম। এরকম বলদ ও কি এ যুগে আছে। আসলে বলদ না। ঘুম না হবার হিস্ট্রি নিতে
যেয়ে যা পেলাম তাতে তাকে বলদ বলা ঠিক হবেনা। বলদ শান্ত প্রকৃতির উপকারী
প্রানী। হাল চাষ বলদ ছাড়া হয়না। হিস্ট্রিতে কি পেলাম সেটা নাইবা বললাম। তবে
মনে হলো এক লাখ নয়। দশ লাখ টাকা দিয়ে কিনলেও তার জন্যে তেমন কিছুনা। লোকটি
ছিলো আদম ব্যাপারী। শেয়ারের ও ব্যবসা ছিলো। আমি তাকে জাস্ট একটা ঘুমের ঔষধ
দেই। আর বলি এ পথ ছেড়ে দিতে। সবার পাওনা পারলে বুঝিয়ে দিতে।
যাকগে,
মতলুব সাহেবের পোষাক সাদা হলে ও তার সান গ্লাসটা গোলাপি। মনে হলো ম্যাচ
করে পরেছেন। কার সাথে ম্যাচ করা? পিংকির সাথে? পিংকিতো সব সময় সাদা আর
গোলাপি পরে। তাই হবে হয়তো। পিংকি এখন খুব একা। তার ছোট জীবন তছনছ হয়ে
যাচ্ছে। কি করবে বা করা উচিত এখন কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। তবে সে এখন তার
পাশে কাউকে চাইছে। মতলুব সাহেব এটা বুঝতে পেরেছেন। ঘর জামাই যারা তারা এসব
বেশ ভালো বুঝেন। বুঝতে হয় তাদের। বুঝে বুঝে ঘরের সবার মন যুগিয়ে তাদের চলতে
হয়।
মতলব
সাহেবের সাথে কথাবার্তায় মোটামুটি বুঝা গেছে তিনি সমঝদার চালাক লোক তবে
অতি চালাক না। অতি চালাক লোকেরা বিপদে পড়ে। তিনি কখনো পড়েননি নি বলে মনে
হয়েছে। তবে একটু বেশি কথা বলার অভ্যাস। কিছুটা সাদাসিধে লোকদের লক্ষণ।
সাদাসিধে লোকরা বেশী কথা বলে। ভিতর বাহির সব কথাই বলে ফেলে। অতি চালাকরা
কথা বলে কম। একে বারে কম। বললেও চিবিয়ে চিবিয়ে দু একটা। মনে হয় কথা গুলো
পেটের গভীর থেকে বরশী দিয়ে টেনেটুনে বের করে আনছে কথাগুলো দুষ্টু প্রকৃতির
আসতে চায়না, বের করে আনতে বেশ কস্ট হচ্ছে ।
মতলুব
সাহেব আজ একটু বিপদেই পড়েই এলেন। মনে হলো তিনি জীবনের এই প্রথম একটি ফাউল
করলেন। একেবারে ডি বক্সের ভিতর ফাউল। এখন পেনাল্টি মাস্ট। তাইতো তিনি
কিছুটা অস্তির। আমার ড্রাইভার বললো, স্যার একটা সাদা পোষাকি লোক সেই সকাল
থেকে হাসপাতালের গেটে ঘুর ঘুর করছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি চান? প্রথমে
কিছু বলেননি। পরে আবার ডেকে বললেন, আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন। মনে
হচ্ছিলো তার খুব বিপদ। দেখা হয়েছে স্যার আপনার সাথে?
আসলেই
তিনি বিপদে। সকালে পিংকিকে সারপ্রাইজ দদেবার নাম করে ওভাবে জড়িয়ে ধরা টা
তার মোটেই ঠিক হয়নি। বিপদ আসন্ন বুঝতে পারছেন। তার ঘর জামাই জীবনের "গূড
উইল" টা এখন এই এক ফাউলেই ভেস্তে যেতে বসেছে। কিন্তু আমার কাছে তেমন মনে
হচ্ছে না।বিপদে পড়লে মানুষ ম্যাচ করে পোষাক পরেনা। এটা একটা প্ল্যান মনে
হচ্ছে। হতেও পারে। এগুলো সমাজে নেই যে তা না। গৃহবধূর চরিত্রে কালিমা লেপন
করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার অনেক নজির ই আছে সোসাইটিতে।
তাহলে
কি এটা ওরকম কিছু। মতলুব সাহেব স্বামী স্ত্রী দুজন মিলেই এই প্ল্যান টি
করেছেন। করতে পারেন। কারন সম্প্রতি পিংকির হাসবেন্ড একটি কাজ করে বসেছেন।
অনুশোচনা থেকেই করা। তার স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি পিংকি কে লিখে
দিয়েছেন। যদি ও পিংকি বলেছিলো, ওসব দিয়ে কি হবে যদি আপনি নাইবা থাকলেন।
তিনি বললেন "আরে দরকার আছে, দরকার আছে, বংশের বাত্তির জন্য দরকার আছে"।
পিংকির চোখ দিয়ে তখন অস্রু ঝরছিলো অঝোর ধারায়। ও সত্য কথাটি বলতে চাইছিলো।
বংশের
বাত্তি আসার কথাটা আসলে ঠিক না। একদম ঠিকনা। সবাইকে খুশী করার জন্যেই বলা।
কিন্তু ও বলতে যেয়েও বলতে পারেনি। লোকটির মন ভেংগে যাবে। এই ক'দিনে বংশের
বাত্তি আসার কথা শুনে সবাই বেজায় খুশি। নোমান ও খুশী। চারদিকে উৎসব উৎসব
ভাব। তাছাড়া সবাই তার প্রতি কেমন যত্নশীল ও হয়ে উঠছে। অথচ সে শুধু নোমানের
শেষ ক'টা দিন হাসিখুশি দেখার জন্যই এই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে। এখনতো দেখছে
অন্য ঝামেলায় সে পড়তে যাচ্ছে।
(চলবে)
লেখক: ডা. সাঈদ এনাম । এম.বি.বি.এস (ডি এম সি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি) সাইকিয়াট্রিস্ট ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
