'বংশের বাত্তি….' - ডা. সাঈদ এনাম

'বংশের বাত্তি….' - ডা. সাঈদ এনাম
ডা. সাঈদ এনাম: এই মুহুর্তে আমি যে রোগী টি দেখছি সেটা রেফার্ড করেছেন নিউরো-মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শোয়েব ভাই(Mohammed Shoab)। অল্প বয়সে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন বাংলাদেশে যে কয়জন তার মধ্যে তিনি অন্যতম। অসীম ধর্য নিয়ে রোগী দেখেন। ভালো ব্যবহার দিয়ে রোগী দের সম্মোহিত করে ফেলেন। আমি সাধারণত রেফার্ড ছাড়া রোগী দেখি না। তবে শোয়েব ভাইয়ের রোগী হলে বেস মনোযোগ দিয়ে দেখি। যা হোক রোগীর কথা বলি। উনিশ বা কুড়ি বছরের একটা চপলা চঞ্চলা কিশোরী যে বয়সে তার কলেজে পড়াশুনা আর হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানোর কথা সে কিনা হঠাৎ করেই হাটতে পারছেনা। তার দু’পা অবস হয়ে গেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে, স্থবির হয়ে গেছে তার জীবন। মা নিয়ে এসেছেন তাকে, সাথে ছোট একটা ভাই। তাদের ধারনা তার ব্রেইন স্ট্রোক।

সবাইকে বের করে আমি তার সাথে কথা বলা শুরু করলাম। কবে থেকে হাঠতে অসুবিধা? কোন উত্তর নাই তার চোখে মুখে। ফ্যাল ফ্যাল করে কেবল তাকিয়ে আছে। “কি অসুবিধা হয় আপনার? আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। আপনি বলুন আমি আপনাকে সাহায্য করবে। এটা শুধু আপনার এবং আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।” সে নিরুত্তর। আমি দেখলাম তার চোখ জ্বলে ভিজে যাচ্ছে। ঠোট কাপছে বোবা কান্নায়। আমি প্রসংগ ডাইভার্ট করে তার শৈশব কৈশোর নিয়ে গল্প করতে চাইলাম। তার পড়াশোনা, বন্ধু বান্ধবী। এবার কাজ হলো। অনেকক্ষণ পর সে কথা বলা শুরু করলো। বলতে লাগলো। কিন্তু এক পর্যায়ে এসে আবার থেমে গেলো। আপনি কি বিবাহিত। সে মাথা নাড়লো। হ্যা। কি করেন তিনি? কিছু করেন না। আগে বিদেশ ছিলেন। এখন দেশে আছেন, কিন্তু অসুস্থ। তিন চার মাস যাবৎ বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। ক’দিন হয়েছে বিয়ের? আট মাস। কি অসুস্থ? “উনার ব্লাড ক্যান্সার। ১৫/২০ দিন পর পর ঢাকা যান। রক্ত দেন…। আর কথা বলতে পারলোনা। তার কন্ঠ ধরে আসলো। আবারো তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো”। “এতে কান্নার কি আছে। অসুস্থ, চিকিৎসা চলছে ভালো হয়ে যাবে”। আমি বললাম। “না উনি মারা যাবেন। এ রোগে কেউ বাঁচেনা। আচ্ছা ডাক্তার সাহেব বলেনতো মানুষের জীবন এমন হয় কেনো? আমিতো এ জীবন চাইনি। আপনি বলবেন, সৃষ্টিকর্তা কেনো আমাকে এতো কষ্ট দিলেন? কি আমার অপরাধ? আমিতো পড়তে চেয়েছিলাম, আপনাদের মতো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলাম”। “দেখো, মানুষ ভবিষ্যৎ জানেনা। মানুষের জীবনে অনেক কিছুই ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা থাকেনা। মানুষের কাজ হলো মানিয়ে নেয়া, চালিয়ে যাওয়া। তোমার ক্ষত্রে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। হয়তো এখন তোমার সময়টা কিছুটা কষ্টের, কিন্তু তার পরও আমি বলবো তুমি উঠে দাঁড়াও। জীবন অনেক বড়ো। হয়তো ভালো কিছু তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে”। “স্যার আমার কি এখন সন্তান নেওয়া ঠিক হবে। ওরা আমাকে খুব প্রেশার দিচ্ছে সন্তান নেবার। তাদের “বংশের বাত্তি” জ্বালানোর মানুষ দরকার। আমি কি করবো। বুঝতে পারছিনা। মাঝেমাঝে মনে হয় সুইসাইড করি”।

“আমি তাকে আরো প্রায় আধাঘণ্টা সাইকোথেরাপি দিলাম। তাকে ভরষা দিলাম। সব শেষে বললাম আমি চাই তুমি হেঠে বাড়ি যাও। তুমি আবার কলেজে ভর্তি হও। আবার জীবন শুরু করো আর বর্ত্তমান কে একটু মানিয়ে যাও। তুমি পারবে। আর আপাতত তুমি ইস্যু নিওনা, আগামী সপ্তাহে তোমার হাসবেন্ড কে নিয়ে অবশ্যই আসবা। দুটো ঔষুধ দিলাম ওগুলা খেও”। “জ্বি খাবো। আচ্ছা ইস্যু নেবোনা কেনো স্যার? উনি কি মারা যাবে এজন্যে”? “আমি হেসে বললাম আরে না, উনি এন্টি ক্যান্সার ড্রাগ নিচ্ছে, নানান রকমের ড্রাগ খাচ্ছে ওগুলার কিছু সাইড এফেক্ট এর ব্যাপার স্যাপার আছে, ও তুমি বুঝবেনা। তোমার হাসবেন্ড কে নিয়ে এসো। আর তোমার মাকে পাঠিয়ে দাও”। ও সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে হেটে গিয়ে তার মাকে পাঠিয়ে দিলো।

“আচ্ছা ব্যাপার কি বলেন তো। স্যার আমার মেয়ে কলেজে পড়তো। পরীর মতো সুন্দর হওয়াটাই তার জন্যে কাল হলো। ওর স্বামী প্রবাসী ছিলো। কলেজের গেট থেকে সে তাকে দেখে পছন্দ করে। এহেনো কাউকে বাদ রাখেনাই এমন কি গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান শেষমেশ আমাদের অনুরোধ করতে থাকেন তার পক্ষে। আমরা না পেরে রাজী হই। তাছাড়া দেখলাম ছেলেটাও বেশ ভালো প্রতিষ্ঠিত। অনেক দিন বিদেশ ছিলো। এলাকায় অনেক ব্যাবসা বানিজ্য। ভাবলাম পড়াশুনা করে কিইবা হবে। ভালো পাত্রতো সবমসময় পাওয়া যায়না”। আপনি থামেন। বড় ধরনের একটা ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা একটা ব্যাপার বলেন তো, আপনাদের জামাইয়ের যে ক্যান্সার এটা কবে থেকে শুরু? “স্যার আমরা জানিনা। আমাদের তারা কিছু বলে নাই। এখনো কিছু পরিষ্কার বলেনা। ক’মাস থেকে বিছানায়। একদম নড়া চড়া করতে পারেনা। কিন্তু ক’দিন ধরে ওর ননদ শ্বাশুড়ি খুব চাপ দিচ্ছিলো আমার মেয়েকে সন্তান নেবার জন্যে। ওদের নাকি “বংশের বাত্তি” দরকার। এতে আমার মেয়ের সন্দেহ হয়। সে তার স্বামীর চিকিৎসার কিছু কাগজ আমার কাছে আনে। পরে আমরা এক ডাক্তারের কাছে জানতে পারি জামাইয়ের ব্লাড ক্যান্সার। স্যার কি বলবো আর বলে মহিলাটি হাঊমাঊ করে কাঁদতে লাগলেন”। ওকে, যা হবার হয়েছে। এখন কান্না করে কি লাভ। এক কাজ করেন। মেয়েকে কলেজে ভর্তি করার চেস্টা করেন। ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। সাহস যোগান। বর্ত্তমান পরিস্থিতি টি একটু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতে সহায়তা করেন। “আমার মেয়ের কি ব্রেইন স্ট্রোক করেছে স্যার? ও কেনো হাঠতে পারেনা। জানেন কাল ও ছাদ থেকে লাফ দিতে চেয়েছিলো”। “না ওর স্ট্রোক হয় নাই। ওর কি হয়েছে আপনি তা বুঝবেন না। বুঝলে কি আর এ বিপর্যয় হয়। ওর হাসবেন্ড সহ আগামী সপ্তাহে আসেন, আর ওকে চোখে চোখে রাখবেন। পারলে হাসপাতালে ভর্তি করে ফেলবেন…….” (চলবে)

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম । এম.বি.বি.এস (ডি এম সি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি) সাইকিয়াট্রিস্ট ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।

Post a Comment

Previous Post Next Post