ডা. সাঈদ এনাম: বৃষ্টির জন্যে আজ একটু দেরী হয়ে গেলো। গত
তিন চার দিন খুব বৃষ্টি হয়েছে। আকালে বৃষ্টি। এ অঞ্চলের হাওরের কাঁচা ধান
নষ্ট হয়ে গেছে। ক'দিন পর যে হাওরে সোনালি ধানের ঢেউয়ে খেলার কথা আজ তা
বানের পানিতে একাকার। কত স্বপ্ন ভেসে গেছে । কৃষকের কান্নার জ্বলে হাওরের
জ্বল নোনা হয়ে গেছে। আসতে পথে গাড়ির জানালা দিয়ে তাই দেখছিলাম। তবে এর প্রভাব তেমন একটা পড়বেনা বোধহয় কারন প্রশাসন বেশ নড়েচড়ে বসছে দেখলাম।
চেম্বারে ভিজিটরের সংখ্যা কম। স্বাভাবিক, এ ধরনের আবহাওয়ায় মানুষ তেমন একটা বের হয় না, কাঁথা মুড়ে শুয়ে কাটায়। খিচুড়ি পাকিয়ে খায়।
মেয়েটি আজ এসছে। ধবধবে সাদা একটা ড্রেস সে পড়েছে আজ। ওয়েটিং রুমের এক কোনে বসে আছে মা সহ। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।
আসসালামু আলাইকুম স্যার।
আচ্ছা ওর'তো আজকে আসার ডেট না।
স্যার রোগী দেব, সিস্টার বললো।
না। এক কাপ কফির কথা বলো। দেখি ফাইল গুলো ।
রোগীর ফাইল গুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম।
সিস্টার এই রোগী কে একটু পরে দাও । বসতে বলো। ভীড় কমলে ওদের নিয়ে বসবো। চা টা কিছু দাও ওদের, বলে মেয়েটির ফাইল টি সিস্টার কে দিলাম।
জ্বী স্যার।
কিছু জরুরী রোগী দেখে নিয়ে তাকে ডাকলাম। এ ভিজিটে তার হাসবেন্ড সহ আসার কথা ছিলো। কিন্তু সেতো আসেনি।
কি ব্যাপার কেমন আছো?
স্যার ভালো।
আজ
সে সেজে কিছুটা পরিপাটি হয়ে এসেছে। হাতে মেহদী। তালুতে সুন্দর আল্পনা
আঁকা, দুটি অক্ষর লেখা P+N। গহনাও পড়েছে। বিয়ের গহনা হবে। চোখে মুখে
ডিপ্রেশন এর কোন ছাপ নেই। চেম্বারে সাধারণত রোগী রা সেজেগুজে আসেনা। তবে
রোগীর এটেন্ডেন্টরা একটু পরিপাটি হয়ে আসে। কিন্তু মেয়েটি আজ সেজে এসেছে।
সাদা ড্রেসে ওকে ভালো লাগছে। বোঝাই যাচ্ছেনা কি ঝড় তার জীবনে বয়ে যাচ্ছে।
তোমার হাসবেন্ড আসেন নি?
না।
তিনি আরো দুর্বল হয়ে গেছেন। মনে হয় বাঁঁচবেন না। এ সপ্তাহে আবার ঢাকা
নেওয়া হবে। আমি ঠিক করেছি এবার আমিও যাবো। জানেন আমি কোনদিন ঢাকা যাইনি।
আমরা প্ল্যান করেছি দুজনে মিলে রিকশায় ঘুরবো ঢাকা শহর।
গুড, ভেরি গুড।
স্যার
ইদানীং উনি কেবল কাঁদেন। হু হু করে আমার হাত ধরে কাঁদেন। সারা রাত কাঁদেন।
মাঝেমাঝে বলেন আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমার খুব কস্ট হয় তার জন্যে। ক'দিন
ধরে আমি তার সাথে থাকার চেষ্টা করছি। আমার খুব মায়া হচ্ছে লোকটার জন্যে।
জানেন কাল রাত তিনি অদ্ভুত কথা বললেন।
কি বললেন?
তিনি যেদিন মারা যাবেন সেদিন যেনো আমি সাদা ড্রেস পড়ি। আমি বললাম ক্যানো?
তিনি
বললেন, আমাকে তিনি প্রথম যেদিন দেখেন তখন নাকি আমি সাদা ড্রেস পড়েই ছিলাম।
আমি অবশ্য সবসময় সাদা ড্রেস ই পড়ি। সাদা আর গোলাপি। আমাকে নাকি খুব মানায়।
হ্যা। যারা সুন্দর তারা সাধারণত তাই করে। যা কিনে সব সাদা আর গোলাপি।
সে হো হো হেসে উঠলো। তার মা ও হেসে উঠলো।
আচ্ছা আজকে তুমি বেশ কথা বলছো। ব্যাপার কি বলতো?
সে একটু থামলো। মনে হলো কিছুটা লজ্জা পেয়েছে।
আমি তার মাকে বললাম, আপনি বাইরে গিয়ে বসুন, আর সিস্টার কে পাঠিয়ে দিন।
তোমার হাসবেন্ড আসেন নি কেনো?
স্যার উনি খুব দুর্বল তাই আসেন নি। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না।
আচ্ছা উনার নামকি নোমান?
হ্যা, কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন।
(মনে হলো ও একটু ধাক্কা খেলো)
আমি হেসে বললাম ঐ যে তোমার হাতে লেখা দুটো অক্ষর।
ও তাইতো , কিন্তু N দিয়ে তো আরো নাম হয়
তা হয়
জানেন
আমার এক বন্ধুর নাম ও ছিলো নোমান। আমাকে খুব পছন্দ করতো। আমরা একি ক্লাসে
ছিলাম। সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করতো কিন্তু কখনো কিছু বলতনা।
তাই। এটা খুবই স্বাভাবিক। সুন্দরী মেয়েদের কে ছেলেরা সুন্দর বলে, কিন্তু ভালোবাসি এই কথাটা বলার সাহস তাদের তেমন হয়না।
কেনো স্যার?
হয়না কারন ছেলেদের ভিতর সবসময় হারাবার একটা ভয় থাকে। এজন্যে চুপচাপ কেবল ভালোবেসে যায়।
একটু চুপ থেকে সে বলল, স্যার আমি আরেকটি কথা বলতে চাই। বলবো?
হ্যা বলো। নিশ্চিন্তে বলো।
উনি
কাল উনার সকল সম্পত্তি, টাকা পয়সা আমার নামে লিখে দিয়েছেন। আর আমাকে
বলেছেন তিনি মারা যাবার পর আমি যেনো আরেকটা বিয়ে করি। আমাদের যদি কোন
সন্তান হয় তাহলে যেন তার নাম রাখি "আলো"। ছেলে হলেও আলো, মেয়ে হলেও আলো। হি
হি...। আর.....
আর কি?
এই বার দেখলাম তার চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
কাঁদছো কেনো।
সে কিছুক্ষন কাদলো। তার পর বললো,
"স্যার
উনি আগে থেকেই জানতেন উনার এই রোগ, রোগ ধরার পর বিদেশ থেকে নাকি উনাকে
পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রথমে অসুখের বিষয় তিনি কাউকে জানান নি। চুপচাপ ছিলেন।
কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে, ছোট ছোট ভাই বোন আর পরিবারের জন্যই এতো বছর বাইরে
ছিলেন তাই এবার দেশে আসার পর উনার পরিবারের সবাই আবার বিয়ের জন্যে চাপ
দিতে থাকে। প্রথমে তিনি এটা সেটা বলে এড়িয়ে যেতে থাকেন। নাটক বাহানা অভিনয়
করেন, কিন্তু হঠাৎ একদিন আমাকে দেখেন। আমাদের কলেজ গেটে। আর প্রথম দেখাতেই
নাকি আমাকে ভালোবেসে ফেলেন, প্রচন্ড রকম ভালবাসা "।
মেয়েটি আর কিছু বলতে পারলো না। তার কন্ঠ ধরে আসলো।
তুমি কি এ বিষয় গুলো আর কাউকে বলেছো?
না স্যার
ঠিক আছে
নোমানের কথা বলো। ঐ যে তোমার সহপাঠী, সে এখন কোথায়?
জানিনা স্যার। আমার বিয়ের পরেই তারা চলে যায়।
কোথায়?
আমি জানি না স্যার।
স্যার
আরেকটি কথা, উনার কি এইডস হয়েছে?! এইডস হলেও তো মানুষের এ রকম হয়। কোন
ঔষধে আর কাজ হয়না। আমরা যে ডাক্তারের কাছেন উনার ফাইল নিয়ে যাই তিনি
পরিষ্কার করে কিছু বলেন নি। বললেন ক্যান্সার জাতীয়। আচ্ছা স্যার এইডস হলেতো
বাচ্চা নেওয়া ঠিক না। বাচ্চার ও এইডস হয় তাইনা?
আমিতো তোমার হাসবেন্ডের ব্যাপারটা পুরো জানিনা। তোমরা যদি আজ উনাকে আনতে তাহলে ভালো হতো।
হাও এভার, তুমি তোমার আম্মা কে পাঠাও। আমি তোমার সাথে পরে আবার কথা বলবো। উনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ও দাড়ালো, সিস্টার এর দিকে একটু তাকালো। সে ফাইল দেখছে অন্য টেবিলে বসে।
ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা ছোট একটা কাগজ আমার টেবিলে রাখলো। পড়বেন স্যার।
আমি
হাতে নিলাম। সামান্য লেখা, এক লাইনের একটি প্রশ্ন। অনেক সময় রোগীরা তাদের
রোগের কথা পয়েন্ট আকারে লিখে আনে। লজ্জা বোধ করে বলতে। তাই লিখে আনে। আমার
সংগ্রহে এমন অনেক আছে। ডি এম সি'র ইন্টার্ন লাইফ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করি।
একবার এক রোগী লিখে আনলো, আমার বাবা খুব খারাপ লোক, তার চরিত্র ভালো না,
তাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে"। এই সব। আরেক বার এক রোগী লিখে আনলো, আমি তাকে
না পেলে রেল লাইনে ঝাপি দেবো"। মাঝে মধ্যে এই লেখা গুলো খুব সুন্দর হয়।
গুছানো।বুঝা যায় সবার ই কিছু না কিছু প্রতিভা আছে।
কিন্তু
সেতো ভিন্ন একটা ব্যাপার লিখলো। খুব সুন্দর হাতের লেখা। গুট গুট করে যত্ন
করে লিখা। লেখার ধরন দেখে বুঝা যায়, সিরিয়াস। একটু চিন্তায় ফেললো মেয়েটা।
তার মা আসলেন। আচ্ছা আপনার মেয়েকে কে এখন কেমন দেখছেন? আপনাদের তো আরো ক'দিন পরে আসার কথা।
স্যার
ও এখন বেশ ভালো। বিশ্বাস করেন আমার মেয়েকে বিয়ের পর থেকে এই প্রথম হাসি
খুশী দেখলাম। সেই প্রথম যখন আমরা বলি, "মা তোর বিয়ে দেব। খুব ভালো একটা
আলাপ । শুনেছি ছেলেটা নাকি তোকে দেখেছে। খুব পছন্দ হয়েছে তার। প্রথম দেখার
পর থেকেই তোর জন্যে পাগল হয়ে গেছে, তোকে ছাড়া নাকি আর কাউকেই বিয়ে করবেনা"
তার পরদিন থেকে সে কেবল কাঁদতো। সারারাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো। কাঁদতে
কাঁদতে আমার আঁচল ভিজিয়ে ফেলতো। কিছু বলতনা, তবে বলতে চাইতো। ওর বাবকে সে
খুব ভয় পায়। আমরা ভেবেছিলাম স্বাভাবিক। মেয়েরা'তো বিয়ে ঠিক হলে এমন টুক টাক
কাঁদে। আমিওতো কেঁদেছি আমার বিয়ের সময়। কিন্তু কই কিছু হয়নি। ভেবেছিলাম ওর
টাও সেরকম, বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু স্যার মেয়েটিকে বিয়ের পর থেকে
আর কাঁদতে দেখিনি হাসতে ও দেখিনি। কেমন আনমনা । তবে এই কদিন থেকে তার ভিতর
অদ্ভুত পরিবর্তন দেখছি। বিশেষ করে আপনার কাছ থেকে যাবার পর। স্যার আমার
মেয়ের মুখের হাসি ফিরিয়ে আনার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার
ভালো করুন। আর আজ আসার কারন সকাল থেকে সে খুব চঞ্চল হয়ে উঠছিলো। বার বার
বলছিলো আপনার সাথে তার কথা বলা দরকার। স্যার আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
আরে
না কিছুনা। আই উইশ সে পুরোপুরি সুস্থ হবে। আবার কলেজে যাবে। সব ঠিক হয়ে
যাবে। আচ্ছা বলুনতো নোমান নামের কেউ কি আছে বা ছিলো যার সাথে তার বন্ধুত্ব
ছিলো এক সময়?
নাহ, কেনো? তবে আমাদের জামাই এর নামতো নোমান!
না, জামাই না অন্য কেউ। ভেবে বলুন।
হ্যা, ভেবেই বলছি।
ওরকম কেউ নেই, কোন কিছু ওর ছিলোও না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যান। খেয়াল রাখবেন ঔষধ যেনো বন্ধ না হয়।
স্যার একটি কথা, ওর কি এখন বাচ্চা নেওয়া উচিৎ?সে এখন নিজেই বলছে বাচ্চা নিবে। অনেক গুলো পুতুল ও কিনেছে।
"বিষয় টি এখন জটিল হয়ে গেছে, আপনাদের জামাই কে আনলে ভালো হবে"।
(চলবে)
লেখক: ডা. সাঈদ এনাম । এম.বি.বি.এস (ডি এম সি) এম ফিল (সাইকিয়াট্রি) সাইকিয়াট্রিস্ট ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
১ম পর্ব পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ ১ম পর্ব লিঙ্ক