নিউজ ডেস্কঃ ‘বিছানায় কান্না করছিল শিশু নাবিল আহমদ। কান্না শুনে আসি। এসে তাকে কোলে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বিছানায় আছড়ে মারি। এতে সে অজ্ঞান হয়ে যায়।’ সিলেটের ছোটমনি নিবাসের শিশু নাবিল আহমদ হত্যার ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করেন ঘাতক আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকা। গতকাল বিকালে সিলেটের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সুলতানা। এর আগে শুক্রবার রাতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সে একইভাবে শিশু হত্যার দায় স্বীকার করেছে। সিলেট মেট্রোপলিটন আদালত-২ এর বিচারক সাইফুর রহমানের আদালতে এ স্বীকারোক্তি গ্রহণ করা হয়। সিলেটের বাগবাড়ীস্থ ছোটোমনি নিবাসের আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকা।
ওই নিবাসের ২ মাস ১১ দিন বয়সী শিশু নাবিল আহমদকে খুনের ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ তাকে আটক করে। এর আগে সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ খুনের ঘটনার সত্যতা পায়। থানায় নিয়ে এলেও আয়া সুলতানা প্রথমে পুলিশকে বিভ্রান্ত করে। পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর পর সে ওই ফুটেজে থাকা আয়া হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে। কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছে, আয়া সুলতানাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসার পর শুক্রবার মামলা দায়েরের আহ্বান জানিয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তাদের লিখিতভাবে জানানো হয়। কিন্তু সমাজসেবার কোনো কর্মকর্তাই এসে থানায় মামলা দায়ের করেননি। পরে শুক্রবার রাতে কোতোয়ালি থানা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর এসআই মাহবুব হোসেন মণ্ডল বাদী হয়ে আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকাকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ জানায়, শিশু নাবিল হত্যা মামলার আসামি সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকাকে আসামি দেখিয়ে গতকাল সিলেটের আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় আদালতের কাছে সুলতানা জবানবন্দিমূলক বক্তব্য প্রদান করেছে। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত ১২ই জুন গোয়াইনঘাটের সমাজসেবা কর্মকর্তা পিতৃ-মাতৃহীন শিশু নাবিল আহমদকে সিলেটের ছোটোমনি নিবাসে পাঠিয়েছিলেন। ২২শে জুলাই রাত ১১টার দিকে ছোটমনি নিবাসে শিশু নাবিল কান্নাকাটি করছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দায়িত্বে থাকা আয়া সুলতানা। এ সময় সে বিরক্ত হয়ে নাবিলকে বিছানা থেকে তুলে ছুড়ে ফেলে। খাটের স্টিলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় শিশুটি। এতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপর তার মুখে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে আয়া সুলতানা। ঘটনা আড়াল করতে পরদিন অসুস্থতায় নাবিলের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে কোতোয়ালি থানায় অপমৃত্যুর মামলা করে কর্তৃপক্ষ। ওইদিনই ময়নাতদন্তের পর শিশুটির লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু শিশুটির মৃত্যু নিয়ে পুলিশের সন্দেহ হয়। পরে অপমৃত্যুর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেটের কোতোয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর মাহবুব হোসেন মণ্ডল সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করলে ওই শিশুকে হত্যার দৃশ্য দেখতে পান। পরে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখের নির্দেশে বৃহস্পতিবার সুলতানাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, আটকের পর আয়া সুলতানা ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করে। পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর পর সে ওই ফুটেজে থাকা মহিলা নিজে বলে জানায়। এরপর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে মুখ খোলে সুলতানা। জিজ্ঞাসাবাদে সে পুলিশকে জানিয়েছে, ‘ঘটনার আগে কান্না করছিল শিশুটি। কান্না শুনেই তিনি তার কাছে যান। এবং তাকে কোলে তুলে খাটের ওপর আছড়ে মারেন। এরপর সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে অসুস্থ হয়েছে জানিয়েছে ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়। পরদিন হাসপাতালে নেয়া হলে শিশু নাবিল আহমদ মারা যায়।
সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) মো. ইয়াসিন আহমদ জানিয়েছেন, আয়া সুলতানা জবানবন্দিতে সে শিশুটিকে আছড়ে মারার কথা স্বীকার করেছে। এ কারণে তাকে গতকাল আদালতে তোলা হলে সে নিজের ইচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ঘটনার দিন শিশু নাবিলসহ কয়েকটি শিশু কান্নাকাটি করায় সে বিরক্ত হয়ে এ কাজ করেছে বলে জানায়। তিনি জানান, মামলার তদন্ত কাজ শেষ করে দ্রুত আদালতে চার্জশিট প্রদান করা হবে।
হত্যাকাণ্ডের স্থান পরিদর্শন: সিলেট নগরীর বাগবাড়ীস্থ ছোটমনি নিবাস কেন্দ্রের আয়া সুলতানা ফেরদৌসী সিদ্দিকার হাতে খুন হওয়া ২ মাসের শিশু নাবিল হত্যাকাণ্ডের স্থান পরিদর্শন করলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। গতকাল বেলা ১টায় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত বাগবাড়ীস্থ ছোটমনি নিবাস কেন্দ্রে যান তিনি। এ সময় তিনি উপ-পরিচালক নিবাস চন্দ্র তাদের ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত করেন। এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানান, পূণ্যভূমি সিলেটে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
আগস্ট মাস হচ্ছে শোকের মাস, এই মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর এই শোকের মাসে পরিবার পরিজন ছাড়া এতিম শিশুদের দেখাশোনার জন্য সিলেটে সরকারি প্রতিষ্ঠান ছোটমনি নিবাসে এ ধরনের একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ছোটমনি নিবাস পরিদর্শনে উপস্থিত ছিলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক কাউন্সিলর জগদীশ চন্দ্র দাস, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডিশনাল পিপি এডভোকেট সৈয়দ শামীম, ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান, ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ প্রমুখ।