পড়তে বসলেই বমি আসে

শিশুর অদ্ভূত সমস্যা নিয়ে বাবুর মা-বাবা ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকেন। ছবি: সংগৃহীত
ডা. সাঈদ এনাম: বাবুর সমস্যা একটিই। পড়তে বসলেই কেবল তার বমির ভাব হয়। শুধু ভাব নয় রীতিমতো খাবার দাবার নাড়ীভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসার মতো। আর কিছুই না। আর এ সমস্যার জন্যে আপাতত তার পড়াশোনা বন্ধ রেখেছেন তার মা বাবা। এটাই স্বাভাবিক। সন্তানের পেট উগলে বমি আসছে এমন দৃশ্য যেকোন মা বাবার কাছে অসহনীয়। আগে তো কলিজার টুকরো বাঁচবে, তারপর পড়াশোনা।

বাবুর বয়স নয় বছর। ক্লাস ফোরে উঠেছে। তার এরকম কোন সমস্যা পুর্বে ছিলো না। গত তিনমাস যাবৎ এ প্রবলেম।

বাবুর বমির সমস্যার জন্যে গত তিনমাস ধরে অনেক চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু কোন উপশম হয়নি।

পড়াশোনা না পারা, স্কুলের যাবার ভয়, স্কুলে শাসনের ভয় বা কঠিন সাবজেক্ট পড়তে বসলে অনেক সময় শিশু কিশোর কিশোরীদের অনেক সময় মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, হাতে পায়ে ব্যথা ইত্যাদি। কিন্তু পড়তে বসলে বমি আসা নিতান্তই নতুন। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, পাঠ্যবই, গল্পের বই যাই বাবু পড়তে বসে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বমি শুরু হয়।

প্রথম সাক্ষাতে তাকে একটা এন্টি ইমেটিক, এনথেলমিন্থিক, ও একটি এন্টি এনজাইটি দিয়ে তার বমির বিষয়টি ভিডিও করে আনতে বলা হলো। কিছু কিছু কেইস আমি ভিডিও করে আনতে বলি, এটা আমাদের স্যারদের কাছ থেকে শিখা। বিশেষ করে নিউরোলজিকাল মৃগী রোগ, কনভারসন ডিসওর্ডার বা ম্যালিংগারিং জাতীয় কিছু রোগ।

দ্বিতীয় সাক্ষাতে তারা আসলেন। বাবুর সমস্যার কোন উপশম হয়নি। কয়েকটি ভিডিও তারা দেখালেন, যা বাবুর অগোচরে তোলা।

বমি আসার বিষয়টি এবার চাক্ষুষ দেখতে চাইলাম।

বাবুকে কয়েকটি গল্পের বই, বাংলা, ইংরেজি ও আরবি সব দিয়ে চেম্বারের পাশে এক এক টেবিলে পড়তে দেয়া হলো। বমি আসলে যাতে বমি করতে পারে সে ব্যবস্থাও নেয়া হলো। বাবু'র মা বাবাকে বলা হলো, পুরো বিষয়টি ভিডিও করা হবে । তাদের কোন আপত্তি আছে কিনা এতে? তারা সানন্দে রাজী হলেন।

বাবু'কে চেম্বারেই টুকটাক কাউনসেলিং এবং অন্যমনস্ক করে টেবিলে পড়তে বসানো হলো, এবং সিস্টার কে ভিডিও করতে বলা হলো।

এদিকে বাবুর মা বাবার সাথে আলাপের মাধ্যমে তার রোগের অতীত ইতিহাস নেয়া চললো।

দুই.

পরপর দুবার দশ মিনিটের ভিডিও করা হলো। এর মধ্যে বাবু তিনবার উঠে গিয়ে বমি করলো। ভানবনিতা নয়। সত্যিকার অর্থেই বমি। গল গল করে। ছেলেটি কাহিল হয়ে পড়েছিলো।

বাবু'র মা বাবার কাছ থেকে তার বার্থ হিস্ট্রি, ডেভেলপমেন্ট হিস্ট্রি, বন্ধুবান্ধব ও স্কুলিং হিস্ট্রি নেয়া সম্পন্ন হলো। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য বেরিয়ে এলো।

বাবু ছিলো প্রি ম্যাচুউর বেবী। জন্মের পর দেখা দেয় আরেক সমস্যা। বুকের দুধ খেলেই প্রচন্ড বমি আসে। তিন দিন একই অবস্থা, কোন উন্নতি নেই। ধীরে ধীরে বাবুর পেট ফুলতে থাকে। বাবুর মা খেয়াল করলেন তার পায়খানা হয়না, এমন কি পায়খানার রাস্তা দিয়ে বাতাস ও যায়না।

এদিকে পেট ফুলার কমতি নেই, পেট ফুলতে ফুলতে শ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়।

তাৎক্ষণিক সদ্যভূমিষ্ট বাবুর অপারেশন এর সিদ্ধান্ত হলো। তিন দিনের মাথায় কলোস্টমি অপারেশন হলো। পেট দিয়ে নলের মাধ্যমে তার পায়খানা করানোর ব্যবস্থাও হলো। তিন মাস পর আবার পায়খানার রাস্তা ঠিক করে দেয়া হলো বাবুর। শিশুসার্জন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ গুলো করলেন।

দু'বছর পর বাবুর আবার একই সমস্যা। আবার হঠাৎ করেই পায়খানা বন্ধ এবং সেই সাথে পেট ফুলে যাওয়া।

আবার সেই সার্জনের শরণাপন্ন হলেন তারা। বাবুর পুনরায় কলোস্টমি অপারেশন হলো। আবার তিনমাস নল দিয়ে পায়খানা। তিনমাস পর পায়খানার রাস্তা পুনরায় জোড়া দেয়া হলো।

এর পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ছ'বছর হয়ে, বাবুর টুকটাক সর্দি-জ্বর ছাড়া আর কোন সমস্যাই হয়নি।

পড়াশোনায় বাবু খুবই ভালো। ক্লাস থ্রী পর্যন্ত রোল এক। খেলাধুলাতেও এগিয়ে। ক্রিকেট তার প্রিয় খেলা হলেও কাছে ডেকে আদর করে জানতে চাইলাম, 'বাবু, বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও'। সে বললো 'ডাক্তার'। জিগ্যেস করলাম, 'ওমা, প্রিয়ো খেলা ক্রিকেট, ক্রিকেটার হবা, ডাক্তার কেনো?'

বাবু বললো পড়তে বসলে বমি আসে। বারবার বমি করতে যেয়ে তার খুব কষ্ট হয়। নাড়ীভুঁড়ি সব বের হয়ে আসতে চায় প্রতিবার। ডাক্তাররা কেউই এটা ভালো করতে পারছেন না। তাই সে নিজের ডাক্তার হয়ে নিজের চিকিৎসা করবে। আমি একটা কলম গিফট করে বললাম, 'মাশাআল্লাহ, অবশ্যই তুমি ভালো হয়ে যাবা' ।

বাবুর এ সমস্যা নিয়ে বাবুর মা-বাবা ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন। তাদের ধারণা, সম্ভবত আবারও বাবুর বড় কোন অপারেশন লাগবে।

কিন্তু সার্জারি বিভাগ থেকে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দেয়া হয়েছে সার্জিক্যাল কোন কেইস নয়। অন্যান্য ডাক্তার চেষ্টা করেছেন বারবার লাভ হয়নি। হুজুর, কবিরাজ ও দেখিয়েছেন এর মধ্যে।

শিশু বিশেষজ্ঞরা এবার বলেছেন সাইকিয়াট্রি দেখাতে।

বাবুর কি কোন মানসিক সমস্যা? জেনারেল এনজাইটি বা কনভারসন ডিসওর্ডার জাতীয় কিছু?

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম

Post a Comment

Previous Post Next Post