লসএন্জেলসের দরকার নাই; নিরাপদ ঢাকা চাই!


এম আর তাহরীম: কি ভয়ংকর আর বিভীষিকাময়ভাবে আমাদের স্বজনেরা, প্রিয়জনেরা দাউ দাউ আগুনে জীবন্ত পুড়ে মরেছে! জ্বলে ছারখার হয়েছে সব। এ যেন এক বিউটিফুল মৃত্যুপুরী! যেখান কোটি প্রাণ আটকে আছে মৃত্যুপুরীর বিউটি স্পটে! বেঁচে আছে একটু শ্বাস- প্রশ্বাসের প্রয়োজনে।
কিন্তু এই মৃত্যুপুরী কোনোকালেই কারও দায় দায়িত্বে নেই! আমাদের ক্ষমতাসীন মন্ত্রীদের নজরে মৃত্যুপুরী ঢাকা শহরটি লসএন্জেলস নতুবা প্যারিসের মত স্বপ্নের রাজ্য। অথচ বিশ্বসংস্থাগুলোর তালিকায় বারবার স্বপ্নের এই শহরটি ভীতিকর ও ভয়ংকর শহরগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান দখল করে আছে। সত্যি সত্যিই তো স্বপ্নের এই শহরটি যেন একটি মরণ ফাঁদ।

এই মরণ ফাঁদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সরকার! রাষ্ট্র কেন এই মৃত্যুপুরীখ্যাত শহরটি নিয়ন্ত্রণে রাখছে না? কেন দিতে পারে না মানুষের জান- মালের নিরাপত্তা? নিমতলী বলেন আর রাজারবাগ বলেন এভাবে আর কত পুড়বে জীবন্ত মানুষগুলো? এভাবে আর কত পোড়া ছাঁই বাতাসে ভাসবে মানুষ পোড়ার?

এই যে পুরান ঢাকার পুরান প্রাণ কেমিক্যালের চকবাজার! কি ভয়ংকর ঘটনার মধ্য দিয়ে কত জীবন পুড়ে বাতিসে ভাসিয়ে দিল স্বজনদের কান্না আর আর্তনাদে -আহাজারিতে! কেউ কল্পনা করেনি আগুন কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আগুন নেভার পর ভোররাতে উদ্ধার করতে গিয়ে একের পর এক বের হয়ে আসে লাশ, পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মানুষের কঙ্কালসার। মানুষগুলো সব স্বপ্ন, আশা- আকাঙ্খা নিমিষেই পুড়ে ছাঁই হল!

এটা কি দুর্ঘটনা বলা যায়? নাহ্! এটা নিঃসন্দেহে একটি গণহত্যা । এর দায় আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাষ্ট্র কখনো এড়িয়ে যেতে পারবে না! এর দায় সরকারকে নিতেই হবে।

এদিকে, পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম অপসারণ নিয়ে শিল্পমন্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র দুই ধরনের মত দিয়েছেন। দায়িত্বশীল এ দুই ব্যক্তির ভিন্ন মতে জনমনে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাতে তাঁরা দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। এখন তাঁরা জোর পদক্ষেপ নেবেন। অথচ শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন-আপনারা কি ভীনগ্রহ থেকে এসেছেন নাকি? আমরা কি ঢাকা শহর গুড়িয়ে দেবো? পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসা বংশ পরম্পরা। এটাতো বন্ধ করা যাবে না। এরসঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। আমি পুরান ঢাকার মানুষ। আমি জানি।

অন্যদিকে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে এই ভয়াবহ মানুষপোড়া অগ্নিকান্ডটি মনোযোগি হওয়ার জন্য একটি শিক্ষামুলক ঘটনা মাত্র! তিনি বলেছেন , শিক্ষা পেলাম , মনযোগী হব। আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে সে জন্য এখন ব্যবস্থা নেব।

কিন্তু মিষ্টার মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, কবে শিক্ষাটা নিয়ে মনোযোগি হলেন বা ব্যবস্থা নিলেন? এটা তো নতুন শিক্ষা মুলক ঘটনা নয়! এরকম একই ঘটনা ঘটল নিমতলীতে! তদন্ত কমিটি হল। কমিটির সুপারিশ ছিল সব কেমিক্যাল কোম্পানী অনত্র অর্থাৎ আবাসিক এলাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু তা কি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল? কেন নেওয়া হল না? কেন দায়িত্ব এড়ানো হল? নাকি এর দায় আপনাদের নয়? সরকারের নয়?
যদি দ্বায়-দায়িত্ব না থাকে বা না নেন তবে সরে দাঁড়ান!

এভাবেই যদি বারবার জীবন্ত মানুষকে জ্বলে-পুড়ে মরতে হয় তাহলে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিংবা সরকার থাকার কী প্রয়োজন? ধুঁকে-ধুঁকে, পুড়ে-পুড়ে, ডুবে-ডুবে, মরতে মরতে বিলীন হয়ে যাই আমরাও!

আসলে এসব কথা বলেও কোনো ফায়দা নেই । দেশবাসি আজ অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে। জিম্মি হয়ে পড়েছে বেঁচে থাকাটাই! শান্তজীবন আটকে পড়েছে অনিরাপদ দেয়ালের পিছনে তথাকথিত উন্নয়নের চাপে আর কতিপয় কিছু সংখ্যক লোকের সীমাহীন লোভের কাছে। লোভিদের হিংস্র থাবায় এভাবে বছরের পর বছর হেরে যায় অগণিত মানুষের জীবন। এই লোভি মানুষগুলো কোনোকালে কারো নিয়ন্ত্রনে নেই! ওরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলে! খেলায় রাষ্ট্রকে দিয়েও!

আপথে-বেপথে কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়! অথচ মানুষের জান মালের নিরাপত্তার কোনো সুপরিকল্পিত উদ্দোগ নেওয়া বা এসবে টাকা খরচ হয় না! নিরাপদ দেশ, নিরাপদ ঢাকার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দোগ নেওয়া হয় না! আমরা ঢাকার মানুষের জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি চাই! গ্যারান্টি চাই আমাদের জীবনের নিরাপত্তারও।

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ চাই না! চাই নিরাপদ বাংলাদেশ। আমাদের ঝলমলে প্যারিস বা লস এন্জেলসের কোনো দরকার নেই । আমাদের নিরাপদ একটি ঢাকা শহর দরকার !

আমরা শুনতে চাই না আর কোনো গর্ভবতি রিয়া স্বামী রিফাতসহ পুড়ে মরার সংবাদ! শুনতে চাই না বোনের বিয়ার কেনাকাটা করতে যাওয়া ভার্সিটি পড়ুয়া কোনো রোহানের পুড়ে মরা খবর! ‘আব্বা, এনামুল পুইড়া মইর‌্যা গেছে’- এই এনামুল পুইড়া মরার খবর আমাদেরকে কাঁদায়! আছিয়া বেগমের ভাই পুড়ে মরল। আছিয়া বেগমের বুকফাটা চিৎকার আমরা আর শুনতে চাই না!

কেইবা আছে এসব শোনার বা বুঝার! তবুও মনকে শান্তনা দেই, একটি সুন্দর সকালের, একটি সুন্দর সুর্যদ্বয়ের প্রতশায়!
 
লেখক: কবি ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Post a Comment

Previous Post Next Post