রোহিঙ্গাদের ফেরা ঠেকাতেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মিয়ানমারে!


অনলাইন ডেস্কঃ রফিক আহমদ ও দিল মোহাম্মদ। দুই রোহিঙ্গার একজন উখিয়ার কুতুপালং, অন্যজন থাইনখালী ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। মিয়ানমারের আরকানের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ ব্যক্ত করে দুজনই বলেন, জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান দল মিয়ানমারের আরাকান পরিদর্শনের অনুমতি পায়নি। আবার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেটিও কৌশলে মিয়ানমার এড়িয়ে যাচ্ছে। এখন মিয়ানমার বিশ্বপরিমণ্ডলে বোঝাতে চাইছে, আরাকান আর্মি স্বাধীনতার দাবিতে মিয়ানমার রাষ্ট্রের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। তাই মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাধ্য হয়ে আরাকান আর্মি দমনে অভিযান চালাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকানোর পাশাপাশি সেখানে এখনো বাস করছে এমন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার আয়োজন চলছে।

দুই রোহিঙ্গা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আরাকান প্রদেশটি আয়তনে বেশ বড়। সেখানকার ১৭টি থানা এলাকায় সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। ওই অঞ্চলে মাত্র দুটি থানা বুচিডং ও মংডুতে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনীর সংঘাত চলছে। বাকি এলাকাগুলোতে চলছে না। আর এ দুটি এলাকা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত। তাই স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যায়, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সংঘাত সৃষ্টি করে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কাজটুকুই করা হচ্ছে কৌশলে। তাঁরা দাবি করেন, নিকট অতীতে রোহিঙ্গাদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করেছিল মিয়ানমার বাহিনী। এখন আরাকান আর্মির ওপর ততটা কঠোরভাবে অভিযান হচ্ছে না। আর আরাকান আর্মির যোদ্ধারা সবাই বৌদ্ধ। তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে বুচিডং ও মংডুতে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনীর সংঘাত অব্যাহত আছে। গত ১৯ জানুয়ারি রাখাইনের বুচিডং এলাকায় আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এরপর রাখাইন সম্প্রদায় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। একই দিন আরো তিনটি এলাকায় সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় আরাকান আর্মি। হামলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তাসহ ১৭ সেনা নিহত ও ১০ সেনা আহত হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে হেলিকপ্টারযোগে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ভারত সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার। ১৮

জানুয়ারি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জ মিন থুন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি এক বিবৃতিতে মিয়ানমারে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সেনাদের আদেশ দিয়েছেন।

এর আগে ৭ জানুয়ারি নেপিডোতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক এক সভায় মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দাবি করেন, গত ২৩ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি ও আরসা বাংলাদেশের রামুতে এক বৈঠকের পর ৪ জানুয়ারি রাখাইনে চারটি পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালায়। আরাকান আর্মি ও আরসা বাংলাদেশের রামুতে বৈঠকের যে দাবি মিয়ানমার উত্থাপন করেছে, তা কড়া ভাষায় নাকচ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদীকে বাংলাদেশ প্রশ্রয় দেয় না। রামুতে এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। মিয়ানমারের এই দাবি অসত্য।

এরই মধ্যে গত ১১ জানুয়ারি আরাকান আর্মির প্রধান থা রা জাইং সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘আরাকান অঞ্চলের জনগণ এক হয়েছে। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে আরাকান অঞ্চল আমরাই শাসন করব। সরকার কিছুতেই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সরকার অবৈধভাবে আরাকান অঞ্চল বিক্রি করে দিয়েছে। আরাকান অঞ্চলের জনগণের জন্য কিছুই করেনি সরকার।’ তাঁর এমন ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিনই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যোদ্ধাদের সংঘাত হচ্ছে। আরাকান আর্মি প্রধানের ‘সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে আমরাই আরাকান শাসন করব’ এমন বক্তব্যের মধ্যেই ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলা দেখছে এপারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। তারা দাবি করছে, আরকান আর্মি মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোপন চুক্তি করে রোহিঙ্গাদের জন্মভূতিতে এই ধরনের শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চাইছে। তারা সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে বিতাড়ন নিশ্চিত করে আরাকানে বৌদ্ধদের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ নিশ্চিত করতে চায়।

রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি অনুযায়ী গত ১৫ নভেম্বর ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের শুরুর দিন। কিন্তু আমাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানসহ মৌলিক অধিকারের কোনো শর্তই পূরণ করেনি মিয়ানমার। এ কারণে আমরা আরাকানে যাইনি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হলে আমরা অবশ্যই আরাকানে চলে যাব। আমরা আরাকানের ভূমিপুত্র।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৫ নভেম্বরের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কৌশলে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়। তা চূড়ান্ত রূপ নেয় মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবস ৪ জানুয়ারি এসে। এর পর থেকেই মংডু ও বুচিডংয়ে ধারাবাহিকভাবে ধাওয়াধাওয়ি অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি। এমন অশান্ত পরিবেশের অজুহাতেই এখন আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো কথাই বলছে না মিয়ানমার।’ দিল মোহাম্মদ আরো বলেন, মিয়ানমার সরকারের কৌশলে সৃষ্ট সংঘাত দেখে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে, আরাকানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বুঝতে পারছে না, মিয়ানমারই কৌশলে পরিবেশ অশান্ত করে রেখেছে, যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post