কাঁঠাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা মুখরোচক খাবার



নিউজ ডেস্কঃ দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল সংরক্ষণের আধুনিক কোন পদ্ধতি না থাকায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কাঁঠাল নষ্ট হয়। তাই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার করতে ১২টির বেশি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে ২০টির মত পণ্য উৎপাদন করেছেন। পাশাপাশি তারা এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য তুলনামূলকভাবে স্বল্প মূল্যের যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেছেন। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে উৎপাদিত শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ভাগ কাঁঠাল নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

বারি’র শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এম জি ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, বারি’র এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রযুক্তি সংকটের কারণে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের অভাবে গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকার কাঁঠাল নষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালে গবেষণা শুরু করেন। প্রায় ৩ বছরের গবেষণায় তারা এ পর্যন্ত ১২টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন, যেগুলোর সফল বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ প্রযুক্তিকে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে প্রায় ২৫০ জন পুরুষ ও নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে উৎপাদিত শতকরা ৪০-৪৫ভাগ কাঁঠাল নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে নানা ধরনের কাঁঠাল পণ্য উৎপাদন করে দেশের কয়েকটি সুপারশপে মার্কেটিং শুরু করেছেন অনেকেই।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে “কাঁঠাল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, পদ্ধতি ও বাজারজাতকরন” শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে এ গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

ফেরদৌস চৌধুরী আরো বলেন, গবেষণার মাধ্যমে যে সব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, এগুলো প্রয়োগের ফলে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের মাধ্যমে নানা ধরনের মুখরোচক ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরি করা হচ্ছে। দেশব্যাপী এসব প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে দেশের জাতীয় ফল কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার যেমন বাড়বে, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধনাত্মক প্রভাব ফেলবে। প্রতি বছর আমাদের দেশে ১০ দশমিক ৩৮ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদিত হলেও প্রায় অর্ধেক কাঁঠালই নষ্ট হয়ে যেতো। ফলে কৃষকরা বঞ্চিত হতো, আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতো তারা। তাছাড়া দেশের সব এলাকায় কাঁঠাল সহজলভ্য না থাকায় জাতীয় ফলের স্বাদ নিতে পারতো না অনেকেই। কিন্ত এখন থেকে মৌসুম ছাড়াও প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পাওয়া যাবে। দেশের সব জায়গায় বাজারজাত করতে পারলে তা সবার নিকট সহজলভ্য হবে। এছাড়াও এ কৃষিশিল্পে তৈরি হবে অনেক নতুন উদ্যোক্তা।

তিনি বলেন, আমাদের উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাঁচা এবং পাকা দুইভাবে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করা যায়। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় ২০ ধরনের খাদ্য প্রস্তত করা হচ্ছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কাঁঠালের চিপস, আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি, কাঁঠালসত্ত্ব, ফ্রেশ কাট (কাঁচা), ফ্রেশ কাট (পাকা), চিনির দ্রবণে কাঁঠাল, কাঁঠাল শুঁটকি, এঁচোর, লবন দ্রবণে কাঁচা কাঁঠাল (দীর্ঘ সময় সংরক্ষনের জন্য), ড্রাইড পাউডার, ভেজিটেবল রোল, অসমোটিক্যালী ডিহাইড্রেট জেকফ্রুট, রোস্টেড জেকফ্রুট সিড ইত্যাদি।

কাঁঠালশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশের ৪টি বিভাগের ৮টি জেলা গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নওগা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে ২৫০ জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই এসব পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে রাজধানীর মিনাবাজারসহ কয়েকটি সুপারশপে বিক্রি হচ্ছে তাদের উৎপাদিত পণ্য। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করার জন্যও কেউ কেউ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকার কাওলা এলাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছমা সরকার নিজে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গাজীপুরের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠান প্রসপারেটিভ এর মাধ্যমে গত বছর উৎপাদনে যান তিনি। কিন্ত করোনার কারণে বেশিদূর এগোতে পারেননি। এবার কয়েকজন নারী কর্মীকে সাথে নিয়ে কাঁচা কাঠালের বিভিন্ন প্রোডাক্ট উৎপাদন করে বাজারজাত শুরু করেন। তিনি মিনাবাজারের উত্তরা, শান্তিনগর ও ধানমন্ডি শাখায় তার পণ্য বিক্রি করছেন। এছাড়াও শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত কৃষক বাজারে নিয়মিত বাজরজাত করছেন। তিনি পাকা কাঁঠালের পণ্যও উৎপাদন করছেন।

তিনি বলেন, কাঠালের এসব প্রক্রিয়াজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সঠিকভাবে মার্কেটিং করতে পারলে ও সরকারের সহযোগিতা পেলে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে এটা বিরাট ভূমিকা পালন করবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি বিভাগের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাফিজুল হক খান বলেন, সারা বিশ্বে কাঁঠালকে কেন্দ্র করে একটি বাজার চলমান থাকলেও আমাদের দেশে বিপুল পরিমান কাঁঠাল নষ্ট হচ্ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা অবশেষে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু করেছি। এখন উদ্যোক্তা তৈরি ও নিরাপদ এ খাদ্য বাজারজাতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারা বছর ধরে এ ফলের স্বাদ আস্বাদনের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার।

Post a Comment

Previous Post Next Post