অনলাইন
ডেস্কঃ যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতির ঘটনা পুরাতন হলেও এখন অভিনব কায়দায় চলছে
বাস ডাকাতির ঘটনা। রাতের সড়কে বাসে উঠে বোঝার উপায় নেই সিটে বসে থাকা
মানুষরা যাত্রী নাকি ডাকাত। আদতে এদের বেশিরভাগই ডাকাত! রাস্তা থেকে যাত্রী
উঠিয়ে বাসভর্তি ওইসব ডাকাত কেড়ে নেয় সবকিছু। এরপর ফেলে দেয়া হয় নির্জন
কোথাও। জীবিত অথবা মৃত।
ভারতের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’র আদলে এভাবেই ডাকাতি করে আসছে একটি ডাকাত চক্র।
শুরুতে
ডাকাতির জন্য পুরো একটি বাস ভাড়া করে ডাকাতেরা। ১৫ থেকে ২০ জনের একটি
গ্রুপে কেউ চালক, কেউ হেল্পার, কেউ যাত্রী হয়ে বসে সাধারণ যাত্রীদের
অপেক্ষায়। এছাড়াও কখনো স্টাফ বাস, কখনও রিজার্ভ বাস, কখনও নিজেরাই রুটের
নাম দিয়ে বাসের যাত্রী তুলছে।
সম্প্রতি একটি মামলার রহস্য উন্মোচনে
এমনই দুর্ধর্ষ এক ডাকাত দলের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে
চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এ অভিনব কায়দায় ডাকাতি চলছে গাবতলী থেকে ধামরাই অথবা
গাবতলী থেকে আশুলিয়া ও গাজীপুর রুটে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে,
পোশাক কারখানার স্টাফ বাস বা টার্মিনালে পড়ে থাকা মিনিবাস ভাড়া করে এই
ডাকাতি করে থাকে চক্রগুলো। এসব ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয় খুবই কম। কেবল খুনের
ঘটনা ঘটলেই হত্যা মামলা হয়। গত একমাসে এরকম অন্তত সাতটি ডাকাতির ঘটনা
ঘটেছে এই রুটে। এর দুটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলা দুটি পুলিশ ব্যুরো অব
ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করেছে। গ্রেপ্তার করেছে দুটি চক্র।
কীভাবে তারা ডাকাতি করে
গত
২৪ জুলাই রাত আনুমানিক ২টায় গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট যাওয়ার জন্য সাভারের
হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাইদুল ইসলাম। ঈদের আগে বাড়িতে
যাবেন, তাই সঙ্গে কিছু টাকাও ছিল। হঠাৎ আমিনবাজার এলাকা থেকে ‘স্টাফ বাস’
লেখা একটি যাত্রীবাহী মিনিবাস আসে। তারা যাত্রী ডাকছিল। মাইদুল তাদের ডাকে
সাড়া দিয়ে বাসে ওঠেন। বাসে উঠে দেখতে পান আরো ৭-৮ জন যাত্রী বসা। কিছুদূর
যাওয়ার পরই যাত্রীরা সব উঠে দাঁড়ায়। বাসের দরজা-জানালা আটকে সবাই হাতে রড
নিয়ে তাকে মারধর করে সর্বোচ্চ লুটে নেয়।
মাইদুল বলেন, ‘মুহূর্তেই
তারা আমার হাত-পা ও মুখ বেঁধে মারধর করে। আমার মানিব্যাগ ও পকেটের টাকা
নিয়ে নেয়। বিকাশে কিছু টাকা ছিল, তাও নিয়ে নেয়। ঘণ্টাখানেক পর আমাকে চোখ
বাঁধা অবস্থায় এক জায়গায় ফেলে রেখে যায়। আমি সড়কের পাশেই পড়ে রইলাম। হাত-পা
নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। আমার চোখও বাঁধা,
কিছু দেখতেও পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ পর একজন রিকশাওয়ালা আমাকে এসে তুলে
হাত-পা ও চোখের বাঁধন খুলে দেন। আমি জায়গা চিনতে পারছিলাম না। আমার চোখ
দিয়ে রক্ত পড়ছিল। রিকশাওয়ালা জানায় ওই স্থানটি ছিল আমিনবাজার তুরাগ নদের
তীর। পরে সে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরের দিন ভোরে আমার ভাই এসে
সিরাজগঞ্জ নিয়ে যায়। আমি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি।’
ঘটনার পর
মাইদুল সাভার থানায় মামলা করতে যান। তবে পুলিশ একটা জিডি নেয়। এরপর তিনি
আদালতে মামলা করেন। আদালত পরবর্তীতে থানায় নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেন।
এরপর মাইদুল বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন।
মামলাটি ঢাকা জেলা পিবিআই
উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) সালেহ ইমরান তদন্ত শুরু করেন। মাইদুলের যে বিকাশ
নম্বর থেকে ডাকাতরা অন্য একটি নম্বরে সেন্ড মানি করেছিল, সেই নম্বরটি
শনাক্ত করে পিবিআই। এরপর ধামরাই ও সাভার থেকে লালন সরদার ও আলমগীর হোসেন
নামে দুই ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় মাইদুলের
মোবাইল। বাসটিও শনাক্ত করা হয়। বাসটি ধামরাইয়ের এক গার্মেন্টসের। পোশাক
শ্রমিকদের যাতায়াতে বাসটি ব্যবহার করা হয়। আর গ্রেপ্তার লালন বাসটির চালক।
মামলার
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান বলেন, গত কোরবানির ঈদের কিছুদিন আগে এই
গ্রুপটি গার্মেন্টসের স্টাফ বাস নিয়ে ডাকাতিতে নামে। মূলত গার্মেন্টস ছুটির
পর শ্রমিকদের পৌঁছে দিয়ে মধ্যরাতে তারা এই কাজটি করে। বাসটি চালাতো লালন
সরদার। তার কাছ থেকে বাদীর মোবাইলফোন উদ্ধার করা হয়েছে। সে আদালতে
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। লালনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধামরাই
থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত বাস এবং সহযোগী আলমগীর নামের এক ডাকাতকে
গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার লালন এবং আলমগীরের দেয়া জবানবন্দি থেকে
জানা যায়, এই ঘটনায় পলাতক অন্যান্য সহযোগীর বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে একাধিক
ডাকাতি এবং ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনায় পলাতক অন্য ডাকাতদের
গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তা।
তিনি
আরো জানান, বাসটি নিয়ে এর আগেও তারা ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এসব ঘটনায়
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলা করেননি ভুক্তভোগীরা। মূলত আমিনবাজারের পর থেকে
ডাকাতরা যাত্রী তোলে। এরপর সুবিধামতো জায়গায় যাত্রীদের মারধর করে সবকিছু
রেখে তুরাগের পাড়ে ফেলে দিয়ে যায়। মধ্যরাতে সড়ক ফাঁকা থাকায় তারা বাস নিয়ে
ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে। গ্রেপ্তার লালন ও আলমগীরের বিরুদ্ধে ছিনতাই ও মাদকের
একাধিক মামলা রয়েছে। মধুপুরে একবার মোটরসাইকেল চুরি করতে গিয়েও গ্রেপ্তার
হয়েছিল তারা।
সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় এভাবে ডাকাতি করতে গিয়ে
চক্রগুলো অনেককে হত্যা করে ফেলে। গত ৫ অক্টোবর রাতে সাভারের বলিয়াপুর এলাকা
থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরবর্তীতে জানা যায় তার
নাম লস্কর রবিউল ইসলাম। এই ঘটনায় সাভার থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। মামলাটি
তদন্ত করতে গিয়ে গত ১৩ অক্টোবর ৯ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।
পরবর্তীতে
পিবিআই জানতে পারে, পটুয়াখালীর বসির মোল্লার নেতৃত্বে একটি ডাকাত দল বাস
ভাড়া করে ডাকাতি করতে গিয়ে রবিউলকে হত্যা করে বলিয়াপুর যমুনা ন্যাচারাল
পার্কের পাশে ফেলে রেখে যায়।
এ বিষয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ
কুমার মজুমদার বলেন, ‘অভিনব পদ্ধতিতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২০-২২ জনের
অপরাধী চক্র কয়েকদিনের জন্য একটি বাস ভাড়া নেয়। চক্রের সদস্যরাই চালক,
হেল্পার ও যাত্রী সাজে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, নিজেদের ২০-২২ জন সদস্যকে বাসে
নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। অনেক যাত্রী দেখে সাধারণ যাত্রীরা বাসে ওঠেন। বাসে
ওঠার পর তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া হয়। এরপর যাত্রীকে আহত বা নিহত অবস্থায়
সুবিধামতো জায়গায় ফেলে রেখে যায় অপরাধীরা।’
এই চক্র একেক রুট বা সড়কে একেক সময় ডাকাতি করে বলেও জানিয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। সুত্রঃ বাংলাদেশ জার্নাল
