নোহকালিকাই ঝরনার স্মৃতি

 


এম. সফিকুল ইসলাম: সেই ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণ ভালোবাসি। ভ্রমণের কথা চিন্তা করতেই মনের মধ্যে একটা গভীর সুখ অনুভব করতাম। ভ্রমণের গল্প পড়ার সময় মনে মনে কল্পনা করতাম আর ভাবতাম আহা আমি যদি এভাবে কোথাও যেতে পারতাম। ছোটবেলার সেই অদম্য ইচ্ছার কারণেই হয়ত পরবর্তীতে আমি ভ্রমণের অনেক সুযোগ পেয়েছি এবং এখনও নিয়মিত ভ্রমণ করেছি এবং আশা রাখি আগামীতেও নিয়মিত ভ্রমণ করার।

এখন করোনাকাল চলছে। সারাবিশ্ব আজ স্থবির। প্রায় দু’মাসের উপরে হয়েছে বাড়িতে বসে আছি। গেল ঈদে ভ্রমণের একটা পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু এই কোভিড-১৯ কারণে সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সারাক্ষণ মনের মধ্যে পুরনো ভ্রমণ স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনের গভীরে নাড়া দিচ্ছিল চেরাপুঞ্জি ভ্রমণের স্মৃতি। বিশেষ করে মন থেকে কিছুতেই দূর করতে পারছিলাম না চেরাপুঞ্জির নোহকালিকাই ঝরনার রোমাঞ্চকর কাহিনীর কথা।

ভ্রমণসঙ্গীদের ফোন করে জিজ্ঞেস করছিলাম যে তাদের কি চেরাপুঞ্জির সেই ঝরনার কথা মনে পড়ে? সেই ঝরনার নামকরণের কাহিনী মনে করে আবারও যেতে ইচ্ছা করছে এবং মনের ভিতরে একটা অস্পৃষ্ট অনুভূতি কাজ করছে। সেবার মেঘালয় পর্যটন নিগমের গাড়িতে যাওয়াতে সময়ের অভাবে সেভাবে উপলব্ধি করতে পারি নাই।

অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল মেঘালয়ের শিলং যাওয়ার। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য নিজের চোখে দেখার একটা সুপ্ত বাসনা মনের গভীরে বাসা বেঁধেছিল অনেক দিন থেকেই। বিশেষ করে যখন জাফলং যেতাম, সেখান থেকে অবাক বিস্ময়ে ওপারের বড় বড় পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নিচে স্বচ্ছ নীল জলরাশি, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ঝুলন্ত ব্রিজের উপর দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়িদের ছোটাছুটি দেখে তখনই চলে যেতে ইচ্ছা করত। অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিল। আমি এবং আমার কয়েকজন সহকর্মী ভ্রমণ সঙ্গীসহ বেরিয়ে পড়লাম। সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ঝরনাসহ ছোট বড় অনেক ঝরনাই আমরা সেই সময়ে দেখেছি। কিন্তু নোহকালিকাই ঝরনার কথা সব সময় মনে পড়ে।

ইস্ট খাসি হিলের রংযাইরতেহ গ্রামের নোহকালিকাই ঝরনার (আমরা সবাই যেটাকে নোয়াখালী ঝরনা বলে ডাকতাম) অপরূপ দৃশ্য দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। চতুর্দিকে ভেসে বেড়াচ্ছে ধূসর মেঘ। মেঘের চাদর সরিয়ে কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তো কখনও সামান্য উঁকি দিচ্ছে সূর্য। পাহাড়ের বুক চিরে অঝোর ধারায় নামছে ঝরনা। গুটিকয়েক পর্যটক ছাড়া জনমানব খুব একটা চোখে পড়ে না। আমাদের গাড়ি পৌঁছানোর আগেই গাইড আমাদের সেই ঝরনার নামকরণের কাহিনী শোনালেন। পর্যটন নিগমের গাড়িতে আসতে অবশ্য এই সৌভাগ্য হয়েছে। নয়তবা এটা জানতামই না। গাইড হিন্দি এবং ইংরেজিতে বর্ণনা করছিলেন। কোন কোন গাইড আবার বাংলাও ভাল বলতে পারেন। শুধু সৌন্দর্যই নয়, নোহকালিকাই ঝরনার নামকরণের নেপথ্যে রয়েছ অনেক যন্ত্রণার কাহিনী। আপনারা অনেকেই হয়ত সেটা জানেন। তবুও আমি আবার নস্টালজিয়ায় ফিরে নিয়ে যেতে চাই আপনাদের। সেই কাহিনী শোনে আনন্দের মাঝেও চোখে জল চলে আসছিল।

খাসিদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। বিয়ের পর সাধারণত স্বামী ঘরকন্না করতে চলে আসে স্ত্রীর বাড়িতে। অর্থ উপার্জনের দিকটি মূলত মহিলার সামলান। আর বাড়ির কাজ করেন স্বামী। রংযাইরতেহ গ্রামের সুন্দরী বালিকা লিকাইয়ের জীবনও চলছিল সমাজের নিয়ম মেনেই। তবে বেশিদিন সুখ স্থায়ী হল না লিকাইয়ের। মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্বামীহারা হন লিকাই। একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে শুরু হল তার বৈধব্য যাপন। জঙ্গলে কাঠ কেটে এবং বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেই মা-মেয়ের সংসার চলছিল। এরই মাঝে এক যুবকের মনে দাগ কাটলেন লিকাই। কিন্তু মেয়ে থাকায় দ্বিতীয়বার আর ঘর বাঁধতে রাজি হননি লিকাই। তবে ওই যুবকের অসীম ধৈর্য। ভালবাসার মানুষকে পাওয়ার অদম্য বাসনা তার মনে, যেন তার জন্য সব কিছুই করতে পারে সে। ধীরে ধীরে ওই যুবক লিকাইয়ে চেখে আবারও সাজানো সংসার গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনতে লাগলেন। বেশ কয়েকদিন পর রাজি হয়ে যান লিকাই। আবারও বিয়ে করলেন লিকাই এবং সামাজিক রীতি অনুযায়ী লিকাইয়ের বাড়িতে এসে সংসার করতে শুরু করল যুবক।

দিনে লিকাই কাজ করেন আর মেয়েকে সামলান ওই যুবক। রাতে বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে সময় কাটতে থাকে লিকাইয়ের। প্রথম কয়েকদিন বেশ ভালই লাগছিল তার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রীকে একা চেয়েও পাশে পাননি যুবক। এর জন্য লিকাইয়ের মেয়েকে দায়ী করতেন যুবকটি। রীতিমতো আক্রোশ তৈরি হয়ে যায় যুবকটির মনে। লিকাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেই ছোট্ট মেয়েটিকে বেধড়ক মারধর করতে শুরু করত । যদিও তা ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন না লিকাই। তারপর এলো সেই জঘন্যতম ঘটনার দিন। একদিন সকাল সকাল লিকাই কাজে চলে যান এবং কাজ সেরে বাড়ি ফিরে মেয়েকে দেখতে পাননি তরুণী লিকাই। হাজার খোঁজখবর করতে করতেই দিব্যি মাংস দিয়ে ভাতও খেয়ে ফেলেন লিকাই। এরপর পান সাজাতে বসেন। ওই কাজ করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ লিকাইয়ের। দেখতে পান পানের বাটা থেকে বেরুচ্ছে কাটা আঙুল। মায়ের মনে আর্তনাদ ডেকে ওঠে। এ আঙুল যে মেয়ের ছাড়া আর কারও নয়।

ইতোমধ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন লিকাইয়ের দ্বিতীয় স্বামী। পাহাড়ের কোল থেকে তাকে টেনে বের করে আনেন গ্রামবাসীরা। নিজের মুখে স্বীকার করে কেবলমাত্র আক্রোশের বশেই মেয়েকে খুন করে সে হাড় ফেলে দেয় ওই ঝরনায়। মেয়ের মাংসই মাকে রান্না করে খাওয়ায় সে। তবে এত কিছুর মাঝে আঙুলটি ফেলতে ভুলে যায়। এ কথা শুনে শোকে পাথর হয়ে যায় সন্তানহারা মা লিকাই। কারও কথা না শুনে দৌঁড়ে যান ঝরনার কাছে। সেখানেই ঝাঁপ দেন তিনি। আর কেউই লিকাইকে খুঁজে পাননি। তারপর থেকেই লিকাইয়ের নাম অনুযায়ী ওই ঝরনার নাম হয়েছে নোহকালিকাই। স্থানীয়দের বিশ্বাস ঝরনার জলেই যেন অমরত্ব লাভ করেছে লিকাই। আমি আমার ভ্রমণ সঙ্গীদের আর ওই ঝরনার নাম নিয়ে বিকৃতি (নোয়াখালী) না করার কথা বললাম।

নোহকালিকাই ঝরনার কথা মনে পড়তেই লিকাইয়ের আর্তনাদ কানে বাজে। সেবার আনন্দ অথচ আর্তনাদ নিয়েই বাড়ি ফিরছিলাম। আশা করি একদিন করোনা কালের সমাপ্তি হবে। আবারও একবার সেখানে ছুটে যাব লিকাইয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

Post a Comment

Previous Post Next Post