ফের চোখ রাঙাচ্ছে করোনা !

 



 

এস আলম সুমন: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা ফের চোখ রাঙাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশেও করোনার দ্বিতীয় দফা সংক্রমণের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। আসছে শীত মৌসুমে দ্বিতীয় দফা চোখ রাঙাচ্ছে করোনা এমন আশঙ্কা করছেন তারা। করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে না আসলেও জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। দেশে বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বর্তমানে কিছুটা স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকলেও সংক্রমণের তুলনায় বর্তমানে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া এবং করোনা দ্রত রূপ পরিবর্তনের বিষয়টি আরও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে পার্শ্ববর্তী ভারতে প্রতিদিনই করোনা রোগীর সংখ্যা রেকর্ডসংখ্যক হারে বাড়ছে। তাই বাংলাদেশের ঝুঁকি মারাত্মক। যে কোন সময় আগ্রাসী রূপ ধারণ করতে পারে এই করোনা এমনটি ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
দ্বিতীয় দফায় মহামারি করোনা ভাইরাস ফিরে আসতে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মাঝে ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও স্পেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য সেসব দেশে নিয়মের কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দ্বিতীয় দফায় আরও ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে করোনা।
এদিকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় দফার আঘাত আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার দীর্ঘ প্রায় ছয় মাস পর বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীরসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বলে সভায় উপস্থিত একাধিক নেতৃবৃন্দের বরাত দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সংবাদমাধ্যম বাংলাট্রিবিউন। এ সময় শেখ হাসিনা দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, দ্বিতীয় দফায় আবার বড় ধরনের করোনা সংক্রমণের আঘাত আসতে পারে। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ শুরু হয়েছে। দেশেও ফের করোনা পরিস্থতি অবনতি হতে পারে। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রস্তুত থাকতে হবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছেন, সংক্রমণের যে সংখ্যা বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে তা সঠিক চিত্র নয়, কারণ যথেষ্ট পরীক্ষা হয়নি। সংক্রমিত ব্যক্তিদের  বেশ বড় অংশেরই কোন উপসর্গ নেই। মানুষ করোনা টেস্ট বিমুখ হয়ে পড়েছেন।
গত বছর শীত মৌসুমে চীনের উহান শহর থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়।  এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। দেশে চলতি বছরের ৮ মার্চ করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৫ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। গত ৩১ মে থেকে ধীরে ধীরে ছুটি শিথিল করা হয় এবং বর্তমানে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ছাড়া সব কিছু প্রায় স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে এসেছে। আর এই পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যেও সচেতনতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। সামাজিক দূরত্ব না মানা ও মাস্কছাড়া অবাধ চলাফেরা করছেন মানুষ। এর ফলে আশঙ্কার মাত্রাও বেড়ে গেছে। যেহেতু পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কামুক্তের পর্যায়ে আসেনি তাই আসছে শীতে সংক্রমণের দ্বিতীয় দফায় তরঙ্গ শুরু হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিসিএসআইআর জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষকরা প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ৫ ধরনের স্বতন্ত্র করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও দেশে এ ভাইরাস দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে রূপান্তরের হার প্রায় সাত শতাংশ হলেও বাংলাদেশে এ হার প্রায় ১৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে গত মার্চ মাস থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৮ লাখ ৯ হাজার ৬৭৯টি নমুনা পরীক্ষার মোট করোনা শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৭ হাজার ৩৭২ জন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ৯৭২ জন। এবং সুস্থ হয়েছেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৮৬  জন।  মোট শনাক্তের বিবেচনায় সুস্থতার হার ৭৩ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪১শতাংশ।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের মতে আসন্ন শীতে বাংলাদেশে করেনার দ্বিতীয় তরঙ্গ দেখা দিতে পারে। অনেক দেশে করোনার সংক্রমণে সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে। বর্তমান পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত অবস্থা দেখে আত্মতুষ্টিতে থাকা বা অবহেলা না করার অনুরোধ করছি। যেকোনো সময়ে সংক্রমণ প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে।’
এ বিষয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, সংক্রমণ কিছুটা কম মনে হলেও মৃত্যুর হার ততটা কমেনি। শীতের সময় সংক্রমণ বাড়তে পারে। কারণ শীতেই করোনা মহামারি শুরু হয়েছিল। আসলে মানুষ তো স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় না। এখনও সংক্রমণের হার ১৩-১৪ শতাংশ। এই হার ৫ শতাংশের নীচে নেমে আসলে বলা যাবে আমরা আশঙ্কামুক্ত।  
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম সংখ্যক পরীক্ষা করেছি। একদিন নাম লেখানো, একদিন এসে নমুনা  দেয়া, রেজাল্ট পেতে দেরি, তারপর আবার ফি ধার্য করা, সব মিলিয়ে টেস্ট করতে আসা মানুষজন নানাভাবে নিরুৎসাহিত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে বলা হচ্ছে যারা একান্তই না পেরে বাধ্য হয়ে পরীক্ষা করতে এসেছে, তাদের তথ্য শুধু পাওয়া যাচ্ছে। এতে দেশের করোনা সংক্রতি রোগীর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এরকম আংশিক চিত্র দিয়ে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পূর্বাভাস এবং মহামারি প্রতিরোধের কৌশল তৈরি করা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক জরিপ অনেক বাড়াতে হবে। টেস্ট যদি আমরা অনেক বেশি করতে পারতাম তাহলে রোগটির ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমরা একটি ধারনা পেতে পারতাম। কমিউনিটি পর্যায়ে যাদের উপসর্গ নেই তাদের শনাক্ত করা প্রয়োজন। কারণ, সংক্রমণ বেশ কিছুদিন যাবৎ একই রকম রয়েছে। বিশ্বের  বেশিরভাগ দেশে আমরা দেখেছি করোনাভাইরাস সংক্রমণ তিনমাস পর আবার কমে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে সংক্রমণ একটি বিশেষ উচ্চতায় ওঠার পর তা একই জায়গায় প্রলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে মহামারি প্রতিরোধের বিষয়টা বিজ্ঞান ভিত্তিক নয় তাই এটি প্রলম্বিত হচ্ছে।’ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কয়েকটি সফল দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যেসব দেশ করোনা সংক্রমণ ঘটার সাথে সাথে খুব দ্রুত লকডাউন, পরীক্ষা, কন্টাক্ট  ট্রেসিং, আইসোলেশন, চিকিৎসা ইত্যাদি করেছে, ওই দেশগুলোই সবচেয়ে সফল। আমাদের এখন প্রধান দায়িত্ব আমরা কোন পর্যায়ে আছি সেটা নির্ণয় করতে হবে। দেশের সবগুলো জায়গায় র‌্যান্ডম স্যাম্পলিং কি পরিমাণে মানুষ ইতিমধ্যেই ইনফেকটেড হয়েছে ও এক্সপোজড হয়েছে সেই ধারণাটা তৈরি করা। করোনাভাইরাসকে কিভাবে বাধা দেয়া হবে তার একটা রোডম্যাপ করতে হবে।’

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post