হাকালুকিতে বেড়েছে পোনা মাছ পাচারকারীদের দৌরাত্ম


ইমাদ উদ দীন: ওখানকার হাট গুলো শুধু রাতেই জমজমাট। হাওর তীরের  পোনা মাছের হাট। সংশ্লিষ্টদের কাছে এক নামেই এমন পরিচিতি। এই হাট গুলোর বৈশিষ্ট হল গোপনীয়তায় ক্রেতা বিক্রেতার সমঝোতাতে দ্রুত সম্পন্ন হয় বেচা কেনা। আর গাড়ি যোগে তা দ্রুত পৌছাঁনো হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিনই রাতের আধারেই পোনা মাছ ধরা আর কেনা বেচা। মৌসুমে পুরো হাওর জুড়ে চলে এমন রমরমা ব্যবসা। এখন মৌসুম শেষ পর্যায়ে হলেও থেমে নেই পাচারকারীদের এমন দৌরাত্ব। এমন তথ্য স্থানীয় বাসিন্দাদের। প্রতিদিনই প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কর্মকান্ড চললেও সংশ্লিষ্টরা রহস্যজনক কারনে রয়েছেন নির্বিকার। 
এশিয়ার অন্যতম ও দেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে এখনো অবাধে চলছে দেশীয় প্রজাতির পোনামাছ নিধন। প্রতিদিনই অবাধে পোনামাছ নিধনের কারণে দেশের মিঠা পানির মৎস্য ভান্ডার খ্যাত হাকালুকির মৎস্যসম্পদ এখন হুমকির মুখে। গেল ক’বছর থেকে বন্যা আর একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগে এমনিতে বির্পযস্ত হাওর। আর ২০১৭ সালের আকস্মিক বন্যায় দেশীয় প্রজাতির মাছের মড়কে মাছের আকাল। ওই বছর চৈত্রের অকাল বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বোরো ধান পচেঁ সৃষ্ট বিষক্রিয়ায় মাছ, জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদ মারা যাওয়ার পর আরো ২ দফা বন্যা। প্রথম দফা বন্যায় ক্ষতি হলেও এর পর পর দুটি বন্যায় হাওর তীরবর্তী শতাধীক গ্রামের পুকুর,জলাশয় ও মৎস্য খামার পানিতে তলিয়ে যায়। আর ওই সকল দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎসস্থল গুলো থেকে পানির থোড়ে ওখানকার মাছগুলো ভেঁসে হাওরে আসে। ফলে হাওরের দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠে। সরকারী উদ্যোগেও হাওরে অবমুক্ত করা হয় মাছের পোনা। সবমিলিয়ে হাকালুকিতে অনেকটা মাছের চলমান সংকট কাটিয়ে উঠার অবস্থা সৃষ্টি হয়। কিন্তু পোনামাছ নিধনকারী চক্রের কারনে এখন ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে হাকালুকি হাওরের দেশীয় প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। প্রতিবছরই এই মৌসুমে তৎপর হয়ে উঠে একটি চক্র। তারা বেশি লাভের আশায় পোনা মাছ নিধনে মরিয়া হয়ে উঠে।

জানা যায় প্রাশাসনের নীরবতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় স্থানীয় অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীদের সহায়তায় পাচারকারীরা প্রতিদিনই পুরো হাওর থেকে দুই থেকে তিন মেট্রিক টন পোনা মাছ পাচার করে বিক্রি করছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পাচারকারীদের দৌরাত্ম। অনুসন্ধানে জানা যায় ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে এখনো অনেকটাই ভরপুর হাকালুকির সবকটি জলমহাল।

এ সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন স্থানীয় দরিদ্র মৎস্যজীবীদের দিয়ে হাওরে বেড়জাল, কারেন্ট জাল ও কাপড়ি জালের মাধ্যমে মাছ শিকার করান। এসব জালে আটকা পড়ছে বিভিন্ন জাতের দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা। হাকালুকি হাওর থেকে পোনা মাছ শিকার করে রাত ১০টা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত কুলাউড়া উপজেলার ভূকশীমইলের নবাবগঞ্জ বাজার, তেঘরী ঘাট ও জুড়ী উপজেলার আশুরিঘাট, মানুসিং (কাটানালির পাড়) ও কন্টিনালা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় শিকারীরা তা বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। তাছাড়া বড়লেখা ও ফেঞ্চুগঞ্জ অংশে বেশ ক’টি স্পট দিয়ে রাতের আধারে অথবা ভোর বেলা চলে এই পোনা মাছ কেনা বেচা।

স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের নির্দিষ্ট বিভিন্ন বড় বড় শহরের পাইকারদের কাছে নিলামে বিক্রী করেন। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ এসব পোনামাছ ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে যান সিলেট, হবিগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। বছরের  ৫ মাস  ২৩ সেন্টিমিটারের (৯ ইঞ্চি) চেয়ে কম মাপের শোল, রুই, কাতলা, মৃগেল, কালীবাউশ আইড় এবং বোয়ালসহ সবধরনের পোনা মাছ ধরা ও বিক্রি এবং বেড়জালসহ ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটারের কম ব্যাসার্ধের ফাঁকবিশিষ্ট জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু এসময় জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় ও দারিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীরা তাদেরকে দিয়ে মা মাছের পর পোনা মাছ শিকার করান। এমনটিই জানালেন হাওরতীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার সাদিপুর, মিরশংকর ও জুড়ী উপজেলার বেলাগাঁও ও শাহপুরের মৎস্যজীবী লোকজন। হাওরতীরবর্তী বাসিন্দারা জানান প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের আতাতে বর্ষাকালে প্রতিদিন রাতে ৯ টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত কুলাউড়া’র নবাবগঞ্জ বাজার, তেঘরীঘাট ও জুড়ীর মানুসিংহ বাজার, কন্টিনালা নদীর ব্রিজ সংলগ্ন পাড়ে “রাতের হাট” বসে। হাকালুকি থেকে শিকারীরা পোনা মাছ নিয়ে আসেন এই হাটে। ওই হাট গুলোতে নির্দিষ্ট পাইকারদের কাছে দ্রুত বিক্রি হয় মাছ। পাচারকারী ও ব্যবসায়ীরা স্থানীয় প্রভাবশালীদের লোক হওয়ায় কেউ কিছু বলার সাহস পায়না। তারা জানান পোনা মাছ শিকারে ব্যাবহৃত কারেন্ট জাল ছাড়াও প্রায় দুইশতাধিক বেড়া জাল রয়েছে কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলায়। একেকটি বেড় জাল ৪ শ হাত থেকে তিন হাজার হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এসব জালের মালিক ওইসকল প্রভাবশালীমহল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সুত্র জানায়, কুলাউড়া উপজেলায় ১০-১২ জনের একটি প্রভাবশালী সিন্ডকেট রয়েছে। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে নবাবগঞ্জ ও তেঘরিঘাট এলাকার “রাতের হাট”। তাদের অধীনে সাদিপুর ও মীরশংকর এলাকায় রয়েছে প্রায় ২৫-৩০ টির মত বেড়জাল, বেশকয়েকটি হাটজাল (মাকড়সার জাল) ও ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা। এই সিন্ডকেটের ছত্রছায়ায় স্থানীয় জেলে ছাড়াও রাজনগর উপজেলার বেশ কয়েকজন জেলে ও ব্যবসায়ী হাওর থেকে পোনা পাচারে সক্রিয় রয়েছেন। প্রতি রাতেই প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে পোন মাছ নিয়ে যায় পাচারকারীরা। তবে স্থানীয় বাসিন্ধাদের অভিযোগ প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা এই পাচার কাজ চালায়।

এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলেন আমরা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে পোনা মাছ ও জাল জব্দ এবং জরিমানা করেছি। গভীর রাতে অভিযান পারিচালনা করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে সময়মত তিনটি ডিপার্টমেন্টকে একত্রিত করা যায়না। বিশেষ করে পুলিশ ফোর্স সময়মতো পাওয়া যায়না। তবে কয়েকবার রাতে অভিযানে নেমেছিলাম কিন্তু পাচারকারীরা অভিযানের খবর পেয়ে সটকে পড়ে তাই তাদেরকে ধরা যায়না।

এবিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও পোনামাছ নিধনে সক্রিয় পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইননানূগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে আমরা কয়েকটি অভিযানও চালিয়েছি। আমাদের এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন ওই সময়ে যাতে মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থান হয় সে জন্য খাঁচায় মাছ চাষসহ নানা উদ্যোগ ও উদ্ভাবন নিয়ে এগিয়ে আসছে মৎস্য বিভাগ। তিনি দেশীয় মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সকলকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান।

Post a Comment

Previous Post Next Post