অবশেষে সেই আলোচিত স্কুলছাত্রীর ‘লাশ উত্তোলন’


স্টাফ রিপোর্টারঃ মৃত্যু নিয়ে নানা বির্তক সৃষ্টি হওয়া বরমচালের সেই স্কুল ছাত্রীর লাশ উত্তোলন করা হয়েছে। জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বরমচাল ইউনিয়নের মহলাল (রফিনগর) গ্রামে কবরস্থান থেকে মেয়েটির লাশ উত্তোলন করা হয়। এর আগে গত শুক্রবার (১২ জুলাই) লাশ উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করে কুলাউড়া থানা পুলিশ।

প্রথম থেকেই স্কুলছাত্রী কুলসুমা বেগম তসলিমা (১৭) মৃত্যু নিয়ে নানা বির্তক সৃষ্টি হয় কুলাউড়ায়। মৃত্যুর রহস্যময় বিষয় নিয়ে একাধিক গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে থানা প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। মৃত্যুর সু-নির্দিষ্ট কাগজপত্র চাইলে তা দেখাতে ব্যর্থ হয় মেয়েটির পরিবার। প্র্রেমিকের সাথে দেখা করার পর গ্রাম পুলিশ কর্তৃক বাড়ি পৌঁছে দেয়া, পরে অসুস্থ, অতঃপর পরিবার দাবী -স্ট্রোক করে মৃত্যু হয় ১৭ বছরের কিশোরীর! স্কুলছাত্রীর মুত্যুর পর দ্রুততার সহিত দাফন কাফন সম্পন্ন করে তার পরিবার। এতে সন্দেহ দেখা দেয় স্থানীয়দের মাঝে। ধু¤্রজাল সৃষ্টি হয় মানুষের মনে। স্থানীয়দের কেউ কেউ জানিয়েছেন মৃতদেহের শরীরের গলায় এবং গালে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। তাঁদের ধারণা তাসলিমাকে হত্যা করা হয়েছে।

মৃত্যুর পর নানা প্রশ্ন উঠে। স্কুল ছাত্রী তাসলিমা স্ট্রোক করে মৃত্যু হলে গলায় ও ডান গালে আঘাতের চিহ্নের গুঞ্জণ কেনো আসছে ?, প্রেমিকের সাথে দেখা করতে আসা কুলসুমা বাড়ি ফেরার পর কি হয়েছিলো? কোন কারণ ছাড়াই কি সুস্থ মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে?, বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) কালামিয়ার বাজারে কি ঘটেছে, তা এড়িয়ে কোনো যাচ্ছে কুলসুমার পরিবার? বিষয়টি ধামাচাপা দিতে রাজনৈতিক নেতাদের কেনো আশ্রয় চাইছে স্বজনরা? আর প্রেমিক নওমুসলিম আব্দুল আজিজ (মুসলিম হওয়ার আগের নাম লিটন দাস) মুসলমান হতে সব চেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছেন তাসলিমার আপন চাচা সবুজ, কিন্তু কোন? তবে এসব প্রশ্নের রহস্য খোলাসা হবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসলে।।

জানা যায়, উপজেলার বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী কুলসুমা বেগম তাসলিমা। তার জন্ম নিবন্ধন অনুসারে জন্ম তারিখ ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। স্থানীয় লোকজন জানান, গত ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল আনুমানিক ১১টায় স্কুল ড্রেস পরিহিত ও স্কুলব্যাগসহ  তাসলিমা বরমচাল রেলস্টেশন সংলগ্ন কালামিয়ার বাজারের একটি বাসায় প্রেমিক নওমুসলিম আব্দুল আজিজের সাথে দেখা করতে যায়। বিষয়টি বাজারবাসীর সন্দেহ হলে গ্রামপুলিশ কয়ছর মিয়াসহ ব্যবসায়ীরা ওই বাসায় যান। বাসায় গিয়ে ওই স্কুল ছাত্রীর পরিচয় নিশ্চিত করার পর ব্যবসায়ীরা গ্রামপুলিশ কয়ছর মিয়াকে দিয়ে তাসলিমাকে মহলাল (রফিনগর) গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

মহলাল (রফিনগর) গ্রামের লোকজন জানান, সকালের ঘটনার পর বিকাল আনুমানিক ৫টায় একটি সিএনজি অটোরিক্সায় করে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ির লোকজন তাসলিমাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। রাতে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আবার ফেরৎ আসেন। আসার পর এলাকার মানুষকে জানান, তাসলিমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (স্ট্রোক করে) হয়ে মারা গেছেন। পরদিন শুক্রবার এলাকায় মাইকিং করে সকাল ১১ টায় দাফন করা হয়।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়া এবং পুলিশকে অবহিত না করে তাসলিমার লাশ দাফন করা হয়। তাসলিমার লাশ দেখা মহিলারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাসলিমার গালে একটা আচড় এবং গলায় আঙ্গুল দেবে যাওয়ার চিহ্ন সু-স্পষ্ট ছিলো।



স্কুল ছাত্রী কুলসুমা বেগম তসলিমার প্রেমে পড়ে হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে একটি ছেলে। তার বর্তমান নাম আব্দুল আজিজ (মুসলিম হওয়ার আগের নাম লিটন দাস)। সে পেশায় কাঠমিস্ত্রী। কাজের সুবাদে তাসলিমাদের বাড়িতে যাতায়াত এবং ঘনিষ্টতা। সেই সুবাদে গত ২ বছর থেকে তাসলিমার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আব্দুল আজিজের সাথে ক্রমে তাসলিমাদের পরিবারের সদস্যদের সখ্যতা গড়ে উঠে। তাসলিমার প্রেমে আসক্ত আব্দুল আজিজ ৬ মাস আগে অর্থাৎ গত মাঘ মাসে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হন। তাসলিমার মা মারা যাওয়ার আগে ৪দিন উনার সাথে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে সার্বক্ষণিক ছিলেন। তাসলিমার বাবা জহুর উদ্দিন স্ত্রীর মৃত্যুর পর দেশে ফিরে হৃদরোগে আক্তান্ত হলে আব্দুল আজিজ তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। চিকিৎসা ব্যয়ভারও বহন করেন। তার কাছ থেকে ধাপে ধাপে ২৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছে তাসলিমার পরিবার। তাসলিমার সাথে আব্দুল আজিজের সম্পর্কের বিষয়টি জেনে জহুর উদ্দিন দু’জনকে মারপিটও করেন। এরপর থেকে উভয়ের দেখা স্বাক্ষাৎ কমে যাওয়ায় ঘটনার দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার তাসলিমা বাজারে আসে আব্দুল আজিজের সাথে দেখা করতে।

এদিকে তাসলিমার মৃত্যুর পর হতাশ আব্দুল আজিজ জানান, আমি হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছি তাসলিমার জন্য। তসলিমার পরিবার খুবই উগ্র।
রিবার পরিজন এমনকি ধর্মও ত্যাগ করলাম তাসলিমার জন্য। সেই তাসলিমা এভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। সকালে যখন গ্রামপুলিশ কয়ছর চাচা বাসার দরজা খুলতে বলে, তখন দরজা খুলে তাসলিমা বলেছিলো- ‘আমরা বিয়ে করতে চাই।’ সেই তাসলিমা হার্ট অ্যাটাক করতে পারে না। ওরা তাসলিমা মেরে ফেলেছে’- বলেই কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করেন নওমুসলিম আব্দুল আজিজ।

বরমচাল ইউনিয়নের গ্রামপুলিশ কয়ছর মিয়া জানান, কালামিয়ার বাজারে পাশে আব্দুল আজিজের ভাড়াটিয়া বাসায় তাসলিমাকে পাওয়ার পর তার চাচা জয়নাল মিয়াকে ফোন দেই। তিনি তাসলিমাকে বাড়িতে নিয়ে দেয়ার কথা বলেন। আমি তাসলিমাকে বাড়িতে দিয়ে আসি। কিন্তু বিকালে শুনি তাসলিমা স্ট্রোক করে মারা গেছে। এটা কি করে সম্ভব?

বরমচাল কালামিয়া বাজারের সাধারণ সম্পাদক মাছুম আহমদ চৌধুরী বাজারের পাশের বাসা থেকে তাসলিমাকে উদ্ধারে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মেয়েটিকে গ্রামপুলিশ কয়ছর মিয়াকে দিয়ে তার বাড়িতে পাঠিয়েছি।

বরমচাল ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড মহলাল এলাকার মেম্বার ফখরুল ইসলাম জানান, ঘটনার দিন আমি সিলেট ছিলাম। রাতে ফোন দিয়ে তাসলিমার পরিবার মৃত্যুর বিষয়টি তাকে জানায়। পরদিন সকাল ১১টায় তিনি জানাযায় অংশ নেন। পরে লোকমুখে তিনি মৃত্যু নিয়ে নানা কথা জানতে পারেন।

নিহত তাসলিমার বাবা জহুর উদ্দিন জানান, ঘটনার দিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। বাড়িতে ফিরে মেয়েকে অসুস্থ অবস্থায় বৃহস্পতিবার আছরের পর ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে একঘন্টা পর তাসলিমার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর ২-৩দিন পর পুলিশ বাড়িতে এসেছিলো। বৃহস্পতিবারে কালামিয়ার বাজারে কি ঘটেছে, তা তিনি জানেন না।

এ প্রসঙ্গে কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইয়ারদৌস হাসান বলেন- ‘লাশ উত্তোলন করা হয়েছে। ময়না তদন্ত রিপোর্ট আসলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post