টোকিও'র কফি ও হেড ফোন

ডা. সাঈদ এনামঃ টোকিও টাওয়ার দেখার জন্যে রওয়ানা দেবার আগেই রাইসুল রাব্বিকে বললাম, পাশে কি কোন ইলেকট্রনিক শপ আছে? সে বললো, ভাই কি যে বলেন। পুরোটাই তো ইলেকট্রনিক শহর গেলেই বুঝবেন। কিন্তু কেনো? বললাম, 'আমি একটি হেড ফোন কিনবো। অফিস আসতে যেতে প্রতিদিন আমাকে ঘন্টা দুয়ে গাড়িতে বসে থাকতে হয়। একটু এক ঘোয়েমি কাটাতে গান টান শোনা এই আর কি'। রাইসুল রাব্বি বললো, 'শিওর'।

টোকিও তে যখন পৌছি তখন সন্ধ্যা নেমেছে, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ও। আমরা বৃষ্টি তে ভিজে রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে হেটে যাচ্ছিলাম টাওয়ারের উদ্দেশ্যে । আমি ডা. যুবায়ের ভাই, রাব্বি ও তার একজন বান্ধবী। সে জাপানি বংশোদ্ভূত, টোকিও তে থাকে।

আমাদের সবার বেশ ভালোই লাগছিলো রাতের লাল নীল আলোর সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর আচমকা দমকা হাওয়ার কাক ভেজা হয়ে টোকিও শহরের র ফুটপাত ধরে এগিয়ে যাওয়া। বৃষ্টি কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় রাইসুল বললো, 'ভাই দাঁড়ান'। অসম্ভব সুন্দর ওয়ান টাইম বিভিন্ন রঙের তিনটি ছাতা আমাদের জন্যে কিনে এনে রাব্বি সারপ্রাইজ দিলো। দাম খুব একটা কম নয়। ৭০০ ইয়েন। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬০০ টাকা।

আমি আর যুবায়ের ভাই ছাতা শেয়ার করে যাচ্ছি। একটা কফি শপ চোখে পড়ায় আমরা হুড়োহুড়ি করে সবাই ঢুকলাম কফি খেতে। চমৎকার পরিবেশ। কেউ কফি খাচ্ছে কেউবা লেপটপ, মোবাইলে নেট সার্ফিং করে প্রয়োজনীয় কাজ সারছে, কেউবা গোল হয়ে বসে গল্প করছে। এ কফি শপ স্মোকিং এলাওড ছিলো, পাশে দেখলাম তিন তরুনী কফির সাথে আয়েশ করে সিগারেট গিলছে।

এই প্রথম আমি তরুনীদের সিগারেট খেতে দেখলাম। তরুন তরুনী দের সিগারেট গেলার স্টাইলে খুব একটা তফাৎ নেই। একজন বৃদ্ধ আমাদের সামনে অনেক্ষণ নেট সার্ফিং করছিলেন আর সিগারেট খাচ্ছিলেন। জাপানে স্বাস্থ্যকর ভেজিটেবল সিগারেট পাওয়া যায়। নিকোটিনের মুক্ত ইলেকট্রনিক সিগারেট ও পাওয়া যায়। এগুলো স্বাস্থ্য ঝুকি মুক্ত।

জাপানে আরেকটা বিষয় দেখলাম, এখানে ছেলে মেয়ে এক হয়ে দল বেধে আড্ডায় বসে না। রাস্তায়, ফুটপাতে বা গলি চিপাচুপিতে বসে আড্ডাবাজি খুব একটা চোখে পড়েনি, যাও টুকটাক চোখে পড়েছিলো, তারা হয় মেয়েতে মেয়েতে নতুবা ছেলেতে ছেলেতে। হাতে পত্রিকা বা বই জাতিয় কিছু। আমরা একটু সময় নিয়ে কফি খেলাম কারন বাইরে বৃষ্টি ছিলো বেশ।

টোকিও টাওয়ার দেখে ফেরার সময় রাইসুল নিয়ে গেলো ইলেকট্রনিক সামগ্রীর শপে। সুবিশাল শপ। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন গোছানো আর চুপচাপ। দোকানে কথাবার্তা যাও হচ্ছে বেশ নিচু স্বরে। কেউ যাতে ডিস্টার্ব ফিল না করে। হেডফোন কাউন্টারে গিয়ে চমকে গেলাম। এতো সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের হেড ফোন তাকে তাকে সাজানো কিন্তু দাম দেখে চোখ ছানা বড়া। যেটা পছন্দ হলো সেটার দাম বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪০০০০ চল্লিশ হাজার টাকা।

আমি শপের একজনকে ডেকে আরেকটু কম দামের হেডফোন দেখাতে বললাম। তিনি বিনয়ে আমাকে অপেক্ষাকৃত কম দামের কর্নারে নিয়ে গেলেন। সেখানেও গিয়ে কিনতে পারলাম না। সর্বনিম্ন যেটা ছিলো সেটা বাংলাদেশী টাকায় বারো হাজার টাকা। বারো হাজার টাকায় হেডফোন কেনাটা বিলাসিতা মনে হলো। আমি নিরাশ বদনে কর্নার থেকে ফেরায় দোকানের ম্যানেজার বার বার দুঃখ প্রকাশ করছিলেন আরেকটু কম দামের হেড ফোন তাদের শপে না থাকার জন্যে।

তিনি অতি বিনয়ের সাথে আমার আনুমানিক বাজেট জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ৫০০০ ইয়েন। তিনি আমাকে বললেন, পাশের বিল্ডিং এর দুতলায় কয়েকটা চায়নিজ শপ আছে যেখানে খুব সস্তায় ইলেকট্রনিক সামগ্রী পাওয়া যায়। আমি যেতে চাইলে তিন আমাকে সে মার্কেট টি চিনিয়ে নিয়ে যাবেন। তার বিনয়ে প্রকাশে আবিভূত হলাম, 'বললাম, আমি চাইনিজ টা কিনতে চাচ্ছিনা, জাপানিজ প্রোডাক্ট টি আমার পছন্দের এবং কারন এগুলো বেশ টেকসই ' ।

তিনি অসম্ভব আপ্লুত হলেন আমার কথায়। আমার সাথে হ্যান্ড শেক করে বললেন, 'নেক্সট উইক অবশ্যই ৫০০০ ইয়েনের মধ্যে হেড ফোন এনে রাখবেন। আমি যাতে যাই। আমাকে একটা দিতে পারলে তিনি যারপরনাই খুশি হবেন। তিনি বিনয় প্রকাশ করে এও বললেন, আমি চাইলে আমার কন্টাক্ট এড্রেসে এ বাজেটের কয়েকটি হেড ফোন ক্যটালগ সহ পাঠিয়ে দেবেন। মুল্য পরে দিলেও চলবে। তাতে আমার আবার টোকিওতে আসা লাগবেনা, যদি আমার কোন আপত্তি না থাকে ওতে।

আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, 'মন খারাপের কিছু নেই। আসলে আমি কনফারেন্সে এসেছি, আর মাত্র দুদিন আছি। আপনার ব্যবহার আন্তরিকতা আমার খুবই ভালো লেগেছে, যদি পরবর্তীতে জাপান আসি তবে অবশ্যই দেখা হবে। উত্তরে তিনি খুশি হলেন, একটা কফির অফারও করলেন।

লেখকঃ ডা. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।

Post a Comment

Previous Post Next Post