চা বাগানে ‘আওয়ামী লীগের দুর্গ’ ভাঙতে চায় বিএনপি


অনলাইন ডেস্কঃ মৌলভীবাজার-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী নাসিরউদ্দিন আহমদ মিঠু। বড়লেখা উপজেলায় অহিদাবাদ নামে একটি চা বাগান রয়েছে তাঁর। মিঠুর বাগানেরই এক শ্রমিক নির্বাচন নিয়ে আলাপচারিতায় স্থানীয় এক সাংবাদিককে বলেন, ‘মালিক সাব তো ভোটে দাঁড়াইছে। লোকাল নির্বাচন হলে তাঁরেই ভোট দিতাম। কিন্তু এই ভোটে মা দাঁড়াইছে। ভোট তো তাঁরেও দিতে হইবো। কী যে করি?’

মা বলতে এখানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বুঝিয়েছেন এই শ্রমিক।

চা বাগানের শ্রমিকদের আওয়ামী লীগকে সমর্থনের প্রসঙ্গে টেনে এই গল্পটি শুনিয়েছিলেন ওই সাংবাদিক।

তবে চা শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরিও মনে করেন, এবার চা বাগানের ভোট একচেটিয়া নৌকার বাক্সে নাও পড়তে পারে। তিনি বলেন, চা শ্রমিকরা বংশপরম্পরায় নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আসলেও তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের ভোট এবার ভাগ হতে পারে। তারা বুঝেশুনে, প্রার্থী পছন্দ করেই ভোট দেবে।

দেশের মধ্যে চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চল সিলেট। চা শ্রমিক ইউনিয়নের হিসেব মতে, সিলেট বিভাগে চা শ্রমিকদের প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ভোট রয়েছে। বঙ্গবন্ধু চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার প্রদান করেছেন। সেই থেকে চা বাগানগুলো আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবেই পরিচিত। তবে বারবার ভোট দিয়েও কাঙ্ক্ষিত দাবি দাওয়া আদায় না হওয়া ও নানা বঞ্চনার কারণে তাদের অনেকেরই ক্ষোভ রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতি। কয়েকটি এলাকার প্রার্থী নিয়েও ক্ষুব্ধ তারা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে তরুণ ভোটাররা। এই ক্ষুব্ধ অংশ ও চা শ্রমিকদের তরুণ প্রজন্মের ভোট নিজেদের পক্ষে টানতে মরিয়া বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা।

চা শ্রমিকদের ভোট এবার আওয়ামী লীগ কতোটা নিজেদের দখলে রাখতে পারবে আর বিএনপি কতোটা ভাগ বসাতে পারবে তার উপরও নির্ভর সিলেটের কয়েকটি আসনের জয় পরাজয়। সিলেটের ১৯টি আসনের মধ্যে অন্তত ৭টি আসনে জয়পরাজয়ে বড় ফ্যাক্টর হতে পারেন চা শ্রমিকরা।

সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯১টি চা বাগান মৌলভীবাজারে। চা শ্রমিকদের সংখ্যাও এই জেলার সবচেয়ে বেশি। জেলার ৪টি আসনেই চা শ্রমিকদের বড় অংকের ভোট রয়েছে। এছাড়া সিলেট-১ এবং হবিগঞ্জ-১ ও ৪ আসনে চা শ্রমিকরা হয়ে উঠবেন বড় ফ্যাক্টর।

ইতোমধ্যে এসব আসনের প্রার্থীরা চা শ্রমিকদের কাছে টানতে নানা চেষ্টা চালাচ্ছেন। বাগানের ছোট ছোট রাস্তাগুলো এখন ছেয়ে গেছে নির্বাচনী পোস্টারে। সকাল পেড়িয়ে দুপুর গড়াতেই বাগানের অলিগলি থেকে ভেসে আসে মাইকের আওয়াজ। শ্লোগান ও গানের তালে তালে ভোট উৎসবের রঙ এখন চা বাগানগুলোতে। বাগানগুলোতে গিয়ে প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি প্রার্থীরা দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।

তবে প্রতিশ্রুতর ফুলঝুরিতে এবার আর ভুলতে রাজী নয় চা বাগানের শ্রমিকরা। শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিক রিতা বাউড়ি বলেন, ভোট আসলে কত নেতা বাগানে আসে আর যায়। আমাদের চাচি ডাকে, মাসি ডাকে, ভোট দেওয়ার কথা বলে। হেরা ভোটের সময় হামাদের বিভিন্ন কথা দেয়, স্বপ্ন দেখায়। ভোট শেষ হলে হামদের খবর আর কেউ লয় না।

কমলগঞ্জের মিরতিঙ্গা চা বাগানের সবিতা অলমিক বলেন, এবার আমরা চা শ্রমিক ভোটাররা যোগ্য প্রার্থী দেখে ভোট দিবো। তরুণরা মার্কা দেখে নয় প্রার্থীর গুরুত্ব দেখবে।

শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানের চা শ্রমিক প্রকাশ তাঁতি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই ভোট দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু আমাদের জীবন বদলেনি। এবার আমরা বুঝেশুনেই ভোট দেবো।

মৌলভীবাজারের চারটি আসনে মোট ভোটার ১২ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪২০ জন। তাঁর প্রায় আড়াই লাখই চা শ্রমিক ভোটার। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মৌলভীবাজার-৪ (কমলগঞ্জ- শ্রীমঙ্গল) আসনে। এই আসনে লাখখানেক চা শ্রমিক ভোটার রয়েছেন। এছাড়া মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনে চা শ্রমিক ভোটার রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার। মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ি) আসনে আছেন ৩৯ হাজার।

হবিগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি চা শ্রমিক ভোটার রয়েছেন হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে। এ আসনে চা শ্রমিক ভোটার প্রায় ৬০ হাজার। এছাড়া হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে আছেন আরও প্রায় ১৫ হাজার।

সিলেটের ৬টি আসনের মধ্যে চা শ্রমিকরা রয়েছেন সিলেট-১ ও সিলেট-৪ আসনে। এরমধ্যে সিলেট-১ (সিটি করপোরেশন-সদর) আসনে আছেন ২০ হাজার ও সিলেট-৪ জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ) আসনে আছেন ১৫ হাজার চা শ্রমিক ভোটার।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, চা শ্রমিকরা অন্যকাউকে ভোট দিলেও লোকজন বিশ্বাস করে আমরা নৌকায় ভোট দিয়েছে। একারণে প্রার্থী পছন্দ না হলেও অনেকে নৌকায় ভোট দিয়ে দিতো। তবে এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। ফলে ভোটের হিসেবও এবার বদলাতে পারে।

শ্রমিকদের এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি বলেন, চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার নেই। আমরা ভ’মির অধিকার চাই। সরকারী চাকুরীতে আলাদা কোটা, সম্মানজনক মজুরি চাই, বাগানের বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরীর সুযোগ তৈরি করতে হবে। এছাড়া আমাদের ভাষা সংস্কৃতি সুরক্ষায় শ্রীমঙ্গলে একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। যারা এসব দাবি পূরণের আশ্বাস দেবে এবার আমরা তাদেরই ভোট দেবো।

সিলেট বিভাগের সর্বাধিক চা শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চল মৌলভীবাজার-৪ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. আব্দুস শহীদ বলেন, এই সরকারের আমলে চা বাগানগুলোতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চাবাগানে চা শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। আমি বিজয়ী হলে চা শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাবো।

এই আসনের বিএনপির প্রার্থী মুজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি যদি বিজয়ী হলে চা শ্রমিকের ভূমির অধিকার কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করবো। এছাড়া তাদের মজুরী, শিক্ষা, চিকিৎসার উন্নয়নে কাজ করবো। #সিলেটটুডে

Post a Comment

Previous Post Next Post