মেডিকেল এররঃ হুমায়ুন আহমেদ থেকে অধ্যাপক ডা. মুজিবুর রহমান

ডা. মো: সাঈদ এনামঃ আমরা রোগাক্রান্ত হলে ডাক্তার শরণাপন্ন হই। তার কাছে আমাদের আশা থাকে তিনি আমাকে দেখবেন, ভালো করে পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন। অতঃপর তার মেধা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ঔষধ দিবেন। আমি নির্দ্বিধায় চোখ বুঝে তা সেবন করবো এবং আরোগ্যলাভ করবো। আর যদি তার ব্যত্যয় হয়, ইহলোক ত্যাগ করে আমাদের বিদায় নিতে হয় তাহলে কি আর করা। চরম সত্য কে মেনে নিতে হবে তা যত কষ্টকর হোক।

তবে এখানে একটি কথা আছে চিকিৎসা নিয়ে। পৃথিবীর সব রোগের চিকিৎসা নেই। সব রোগ নির্ণয় করা যায় তাও ঠিক নয়। মেডিকেল সায়ন্সের এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে "ডিউ টু আন নোন এইটিওলজী"। অর্থাৎ কেনো হলো আমরা জানিনা। এখন যদি আপনি একজন চিকিৎসক কে প্রশ্ন করে বসেন, "আপনি কিসের চিকিৎসক, আমার কি রোগ হলো সেটা আপনি বলতে পারলেন না..", সেটা আপনার অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই না।

এ টার্মটি মেডিকেল স্টুডেন্ট রা শুরু থেকে বই পড়ে জেনে নেয়। প্রেকটিক্যাল দেখে প্রথমে থার্ড ইয়ার, পরে ফিফথ ইয়ার, শেষতক ইন্টার্ন লাইফে। তখন সে হাতে কলমে এটা দেখে এবং এর ম্যানেজমেন্ট শিখে। এ রকম একট টপিক আমি প্রথম শিখি ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্ন এর সময়। পঁয়ত্রিশ উর্ধ্ব এক মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি হলেন মাঝেমধ্যে তার পা ফুলে যায় বলে। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে কিছুই পাওয়া গেলোনা। প্রয়াত অধ্যাপক মুজিবুর রহমান স্যার রাউন্ডে এসে বিস্তারিত পড়ালেন পেশেন্ট কে নিয়ে। আমি ছিলাম বেড ডক্টর। স্যার বললেন, "ইডিয়প্যাথিক ইডেমা"। তুমি এটা কাল ডেবিডসন থেকে পড়ে আসবে। আমি সব পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্যার প্রশ্ন ধরলেন, দু একটা। মন খারাপ হলো। এতো পড়লাম, আর প্রশ্ন সাকুল্যে দুইটা...!

স্যারের সাথে এই আমার পরিচয়ের শুরু। স্যার কেনো জানি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি গর্বিত বোধ করতাম দেশ সেরা একজন মেডিসিন লিভার বিশেষজ্ঞ আমাকে সাথে রেখে যত্ন করে পড়ান।

একদিন ভাইরাল ফিভারে আমি দুই দিন ওয়ার্ডে যেতে পারিনি। স্যার আমার খবর করেন। আমি পরে জ্বর নিয়ে স্যারের রাউন্ড ক্লাস গুলোতে এটেন্ড করি। স্যার বললেন, "ভাইরাল ফিভার একটা অসুখ হলো? ঔষধ খেলে সাত দিনে কমবে নইলে এক সপ্তাহ লাগবে"। স্যারের রাউন্ড কখনো মিস করিনি। আড়াই ঘন্টা লাগতো স্যারের রাউন্ডে। প্রতিটি বেডে গিয়ে নিঁখুত ভাবে বেড ডক্টর এর কাছ থেকে হিস্ট্রি আদায় করতেন। সেল্ফ মেডিকেশন এ উৎসাহিত করতেন। বলতেন, "এখন রিফ্লেক্স গ্রো আপ না হলে আর হবেনা"। রিফ্লেক্স মানে হলো রোগী রিসিভ থেকে শুরু করে সুস্থ করে তোলা পর্যন্ত সব গুলো ধাপ "রোল অব থাম্ব" অনুযায়ী একের পর এক ব্যবস্থা নেয়া।

রাউন্ড শেষ হলে আমাদের যে দু তিন জনকে স্যার খুব পছন্দ করতেন তাদের নিয়ে এন্ডোসকপি রুমে যেতেন। স্যারের এন্ডোসকপিতে এটেন্ড করতে। কখনো কখনো স্যার ক্যামেরায় রোগীর পাকস্থলীর ক্ষতস্থান গুলো আমাদের দেখাতেন। পড়া দিতেন। পরের দিন পড়া আদায় করতেন। স্যার আমার আম্মার এন্ডোসকপিটা ও করেছিলেন। আমার আম্মা মুজিব স্যার সম্পর্কে বলেছিলেন, "এতো ভালো মানুষ, এতো ভালো ব্যবহার ডাক্তারদের কখনো দেখিনি"।

স্যার দুর্লভ কঠিন কঠিন কিছু পেশেন্ট নিয়ে সে সময়ে প্রেসিডেন্ট ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী স্যারের সরকারি বাস ভবনে নিয়ে যেতেন। সাথে থাকতো স্যারের প্রিয়ো ও মনোযোগী ছাত্র ছাত্রীরা। প্রেসিডেন্ট স্যার ক্লাস নিতেন।

মুজিব স্যার আমাদের ক'জন কে খুব পছন্দ করতেন। একদিন তিনি আমাদের ক'জন কে নিয়ে বেইলী রোডে নাটক দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা ভুলার মতো না।

একদিন খুব সকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয় হঠাৎ করে ওয়ার্ড পরিদর্শন এ আসলেন। সাড়ে ছ'টা বাজে। তখন ওয়ার্ডে কেউ নেই। আমার নাইট ডিউটি ছিলো। ফ্রেশ হতে যাবো অমনি দেখি পুলিশ,প্রটোকল, সাংবাদিক সাথে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়। সাথে সাথে এপ্রোন লাগিয়ে আমি মন্ত্রী মহোদয় স্যার কে প্রতিটি বেড ঘুরে ঘুরে ব্রিফ করে।

সকাল আটটায় বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল স্যার এসে বিষয় জেনে খুব খুশি হন। বাংলাদেশ টেলিভিশন রাত আটটার সংবাদে নিউজটি দেখায়। এটা দেখে হঠাৎ মুজিব স্যার হঠাঠ আমাকে ফোন করলেন, "তোমাকে টিভি তে দেখলাম, সাঈদ তুমাকে টিভিতে তুমিতো হিরো হয়ে গেলে, এটা হলো পাওনা। কাজ করো এই হবে"।

ইন্টার্ন শেষের পরও সময় সুযোগ হলে স্যারের চেম্বারে যেতাম। স্যারের এতো জনপ্রিয়তা ছিলো যে, স্যার কে অনেক জায়গায় গভীর রাত অবধি চেম্বার করতে হতো। এর মধ্যে কয়েকটা চেম্বার ছিলো গরীব দের জন্যে। সেই গাজীপুরে অজ পাড়াগায়ে, সদর ঘাটের সুমনা ক্লিনিকে, পুরাতন ঢাকার ঢাকা ক্লিনিকে, ধানমন্ডির লেব এইড, সবশেষে এপোলো হসপিটালে স্যার নিয়মিত রোগী দেখতেন। সবখানেই দেড়শতাধিক রোগী স্যার কে দেখতে হতো। আমি দেখতাম এতো ক্লান্ত স্যার তবুও কি সুন্দর হাসি মাখা মুখ দিয়ে সবাই কে দেখছেন। আশ্চর্য প্রতিটি রোগী এতো প্লিজড থাকতো স্যারের উপর, বের হয়ে ই বলতো, "এ যেনো এক ফেরেশতা"। আমি স্যার কে বলতাম, "স্যার কিছু রোগীতো এমনি আসে, কেবল আপনাকে দেখতে"। স্যার মৃদু হেসে বলতেন, "আমি জানি। তোমার ও হবে। আমাকে ফলো করো"।

স্যার খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। স্যার কে কখনো রাগতে দেখিনি। তবে রাগলে স্যার কিছু বলতেন না। চুপ থাকতেন। প্রসংগ পালটে নিতেন। তখন আমরা বুঝে নিতাম স্যার রাগ করেছেন। যেদিন ইমার্জেন্সি এডমিসন থাকতো স্যার বেড ডক্টর কে সেলফ প্রোভিশনাল ডায়াগনোসিস করতে উৎসাহ দিতেন। এমন কি মেডিকেশন ও। স্যার বলতেন, এএতা না হলে শিখা হবেনা। আমাদের গাইড করতেন আই এম ও, রেজিস্টার ও সি এ স্যারেরা। পরদিন শুরু হতো স্যারের মেঘা রাউন্ড। জাস্ট আটটায় শুরু হয়ে দুপুর একটা, একটানা।

অনেক রোগী থাকতো পোস্ট এডমিশন এ। সারা বাংলাদেশের হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ থেকে রেফার্ড হওয়া সব ক্রিটিকেল রোগিতে ওয়ার্ডের বেড ফ্লোর এমন কি বারান্দা সয়লাব হয়ে যেত। তার মধ্যে আবার ভি আই পি, সি আই পি এমনকি ভি ভি আই পি পেশেন্ট ও।

আমরা স্যারের পিছন পিছন ডায়েরী বা হ্যান্ড নোট নিয়ে বেডে বেডে গিয়ে রোগী দেখছি আর স্যারের প্রতিটি কথা লিখছি। সবার যার যার কেইস হিস্ট্রি, ফাইন্ডিংস মুখস্থ বলছে, গায়ে সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথো। মাঝখানে একবার হয়তো বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল স্যার আসতেন। তোফায়েল Tofayel Ahmed স্যার কে সবাই যেমন ভালবাসত তেমনি ভয় পেতো। সবাই দোয়া করতো মেডিসিন ফাইনাল ভাইবা পরীক্ষায় অধ্যাপক তোফায়েল স্যার যাতে সারাক্ষণ বসে থাকেন।

বি সি এস দিয়ে গ্রামে জয়েন করেই স্যার কে ফোন দিলাম। স্যার বললেন মন দিয়ে সেবা করো। গ্রামের মানুষ দের এ রকম সেবা করার সুযোগ আর পাবেনা। আমরাও করে এসেছি। এর সুফল ও পাবে।

কঠিন কেইস পেলে সরাসরি স্যার কে ফোন দিতাম। স্যার খুশি হতেন টেলিফোনে বুঝিয়ে দিতেন। আমার চেম্বারের কিছু ক্রিটিকেল কেইস স্যারের এড্রেস দিয়ে ঢাকা পাঠাতাম। স্যার যত্ন করে দেখে দিতেন। পরে টেলিফোনে সে বিষয়ে ডিসকাস করতাম।

সাইকিয়াট্রিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন এ চান্স পাবার পর ফোন দিলাম স্যার কে। স্যার বললেন, "এটা আমার প্রিয় সাবজেক্ট অবশ্যই পড়বা। আমি চাই তুমি পড়"।

তারপর আর পিছন ফিরে তাকাই নি। ঐ সাবজেক্টেই পোস্ট গ্রাজুয়েশন করি। আমার ইন্টারেস্টিং কেইসগুলো নিয়ে মাঝেমধ্যে স্যারের সাথে ডিসকাস করতাম। ফেইসবুকে আমার কেইস হিস্ট্রিগুলো স্যার পড়তেন। স্যার চাইতেন আমি যেনো কেইস হিস্ট্রি লিখি। মানুষ যাতে সাইকিয়াট্রি নিয়ে সচেতন হয়।

স্যারের সাথে সর্বশেষ কথা হয় এই কদিন আগে। হেসে হেসে বলেছিলাম, স্যার এপোলো তে চেম্বার করবো। সাইকিয়াট্রি কেইস দেখবো। তিনি বললেন, "শিওর, তবে এখানে দুজন আছেন। সমস্যা নাই, তোমার হবে। কিন্তু তার আগে তোমার পোস্টিং ঢাকায় আনতে হবে। এখানে প্রতিদিন চেম্বার করতে হয়"।

আচমকা সেদিন সকালে এগারোটার দিকে ফেইস বুকে এক ডি এম সিয়ান অগ্রজ হঠাৎ এক পোস্ট দিলেন, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান স্যার নেই। সিংগাপুরে চিকিৎসা করাতে যেয়ে অপারেশন জটিলতায় মারা গেছেন। এটা পড়ে কিছুক্ষনের জন্যে আমি চুপ হয়ে যাই। বিশ্বাস করতে পারিনি। ওয়েট করতে থাকি ফেইস বুকের পরবর্তী আপডেট। কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে চোখ বুঝে দুয়া করতেছিলাম, আল্লাহ নিউজটা যেনো ভুল হয়। ফেইসবুকে তো কত ভুয়া মৃত্য সংবাদ থাকে।

না, মুজিব স্যার সত্যি মারা গেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। এক ইতিহাসের মৃত্যু হলো।

মুজিব স্যার ছিলেন দেশের সম্পদ। তাঁর সাথে যাঁদের মেশার সৌভাগ্য হয়েছে কেবল তারাই বলতে পারবেন, তিনি কি ছিলেন, কেমন ছিলেন। ফেরেশতা তুল্য মানুষ। আমার ক্লিনিকেল এক্সামিনেশন ইন্টার্ন এর সময় তাঁর কাছ থেকেই শিখা। প্রতি ঈদ পুজা পার্বনে স্যারের সাথে আমার শুভেচ্ছা কথা বার্তা, এস এম এস আদান প্রদান হতো। মৃত্য সংবাদ শুনার পর থেকে আমি মোবাইলে সেই এস এম এস গুলো পড়তে থাকলাম এক এক করে। চোখের পানি সংবরন করতে পারছিলাম না। স্যার আর শুভেচ্ছা মেসেজ আমাকে দেবেন না। দূর আকাশের "তারা" হয়ে স্যার তাঁর অগণিত ছাত্রদের দেখছেন।

সারের মৃত্যু হয়েছিলো অপারেশন টেবিলে অপারেশন জটিলতায়। মেডিকেলের ভাষায় একে বলে "মেডিকেল এরর"। এই এরর মানতে হবে, মানতে হয়।

মেডিকেল এরর (Medical Error) ইচ্ছে করে কোন চিকিৎসক করেন না। হঠাৎ করে ভুলক্রমে হয়ে যায়। ডাক্তাররাও তো মানুষ। তারা ভুলের উর্ধে নন। কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসা করতে যেয়ে এরকম কিছু হলে (যদিও বা তা খুব কম) রোগী বা তার স্বজনরা মানতে চাননা। অসম্ভব রিএক্ট করেন। ডাক্তার কে মারধর থেকে শুরু করে,হাসপাতাল ভাংচুর, গুম, হত্যা, ফেইস বুক কাঁপিয়ে তুলা এহেন কিছু নাই যে করেন না। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো বিভ্রান্ত হয়ে ও হুজুগের বশে এসব করেন।

বাইরের দেশে এসব কিছুই দেখা যায়না। তারা এমন অভিযোগ হলে বা এমন কিছু ঘটলে প্রথমেই এগুলোর তদন্ত করেন, প্রমান পেলে স্বীকার করেনন, ক্ষমা চান, ফুল রেসপন্সিভিলিটি নেন, ক্ষতিপূরণ ও দেন, এমন কি যেকোন শাস্তি মাথা পেতে নেন। এটা বিবেচ্য হয় মেডিকেল এরর এর কোয়ালিটি ও টাইপ দেখে। এ ব্যপারে রোগী বা তার স্বজন রা কখনোই আইন হাতে তুলে নেননা। তার সে সুযোগ ও নাই।

কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে রোগীরা শুরুতেই ডাক্তার সম্পর্কে প্রচন্ড অবিশ্বাস নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে আসেন। মনে করেন এই বুঝি ডাক্তার রা ইচ্ছে করেই তাকে বা রোগী কে মেরে ফেলবেন। কেবল চিকিৎসা ক্ষেত্রেই নয়, বলা যায় কম বেশি সব ক্ষেত্রেই সেবাগ্রহীতা দের মাঝে প্রচণ্ড অবিশ্বাস বিরাজমান। কেনো....?

মাঝে মাঝে তাই খুব ইচ্ছে হয় বাংলাদেশের মানুষদের এসব কান্ডকির্তী নিয়ে একটা স্টাডি করি, থিসিস করি। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে শতকরা কতজন লোক এরকম মানসিক বিকারগ্রস্ত। পরিসংখ্যানে যা আছে তা আমার কাছে "টিপ অব আইস বার্গ" এর মতো লাগে। বলবেন এ কেমন কথা, কেন? তাহলে আসুন এনিয়ে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সামান্য আলোচনা করে আজকের লেখাটি শেষ করি।

দৈনন্দিন জীবনে কম বেশ আমাদের সবাইকে বাংলাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যেতে হয়। কিন্তু সেখানে যাওয়া মাত্রই আমাদের চোখেমুখে ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক উপর এক ধরনের অবিশ্বাস/শত্রুতামূলক মনোভাব কাজ করে। সারাক্ষণ এ নিয়ে থাকেন উদ্বিগ্ন। আর সে জন্যেই এ ব্যপারে চুন থেকে পান খসলেই ডাক্তার ও নার্সদের উপর রোগীর স্বজনরা চরমভাবে চড়াও হয়। লাঞ্ছিত করতে শুরু করে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রতিটি ইউনিয়ন, প্রতিটি উপজেলা জেলা সদর এবং এমন কি মেডিকেল কলেজে যে পরিমান ডাক্তার, নার্স নির্যাতন, লাঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তা রীতিমত আশংকা জনক। এমন কি কখনো ডাক্তাররা হত্যা, গুম, ধর্ষনের ও শিকার হচ্ছেন অহরহ এ কারনে। মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জেল জরিমানা ডাল ভাত হয়ে গেছে।

আর সব ক্ষত্রেই এর কারন হিসেবে দাবী করা হয় ইচ্ছে করে চিকিৎসায় অবহেলা, ভুল ওষুধপাতি, ভুল চিকিৎসার প্রয়োগ,গাফলতি ইত্যাদি যাবতীয় মনগড়া অভিযোগ, আর গুজব। অথচ তদন্ত করলে দেখা যায় এগুলোর শতকরা ৯৯ ভাগ মিথ্যা, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমন কি এও শোনা গিয়েছে ডাক্তার ওয়ার্ডে ফ্যানের সুইচ চালু করে দেয়নি এজন্যে ডাক্তার কে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে একটি হাসপাতালে। বিশ্বের আর কোথাও এমন টি হচ্ছে বলে আমার জানা নেই।

অথচ ইউরোপ আমেরিকার কথা ধরেন। আমেরিকার এক স্টাডিতে গবেষক রা দেখেছেন, তাদের দেশে কেবল মাত্র "মেডিকেল এরর" (অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতির ভুল ব্যবহার, অপারেশনে এক অংগ কাটতে গিয়ে ভুল ক্রমে অন্য অংগ কেটে ফেলা, ছুরি কাঁচি পেটে রেখে সেলাই করা ইত্যাদি) এর কারনে প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ রোগী মারা যায়..! অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ছয়শতাধিক রোগী মারা যাচ্ছে চিকিৎসা জনিত জটিলতায়। অথচ শুনেছেন বা দেখেছেন আমেরিকার কোথাও মাথায় ব্যাজ লাগিয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে, দল বল নিয়ে হামলে পড়তে কোন ডাক্তার বা ক্লিনিকে কিংবা কোন প্রফেসর এর চেম্বারে? দেখেছেন কোন সাংবাদিক কে তদন্তের আগেই কোন নিউজ করতে? তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট করতে।

না, এসব দেখেন নি, দেখবেন ও না, কারন তারা শিক্ষিত সচেতন। তারা বাংগালীদের মতো বল্গাহীন আবেগী আর হুজুগে না। আর কেউ এসব করলে তাদের হসপিটাল পুলিশ আগে আপনার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে পুচ্ছদেশ লাল করে দেবে। (দুঃখিত পুচ্ছদেশ লাল করা শব্দটি ব্যবহার করায়)। তারা যা করবে তা হলো আপনার কাছ থেক্ব লিখিত অভিযোগ নিবে। যাচাই বাছাই করবে। অথবা তারা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করবে। সত্য উদঘাটন করবে এবং সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে। তার আগে আপনি টু শব্দ করতে পারবেন না। করলে আপনাকে ডিফেমেশনের আওতায় আনা হবে।

এই যে সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত গ্যস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট, আমার অতি প্রিয় এবং কাছের শিক্ষা গুরু মহান ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ভুইঞা স্যার মারা গেলেন সিংগাপুরের হাসপাতালে অপারেশন জটিলতায়, আপনারা কি দেখেছেন সিংগাপুরের কোথাও কোন সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ হাসপাতাল বা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের উপর হামলে পড়তে? কান্নাকাটি, চিৎকার, আহাজারি করে কোন সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তব্য বা বিবৃতি দিতে। দেখেননি।

কিন্তু তারা সাথেসাথে এটার তদন্ত করছেন। কারন এমনটি হবার কথা না ছিলোনা। মুজিব স্যার ছিলেন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একজন প্রখ্যাত লিভার বিশেষজ্ঞ। তার অনেক স্টুডেন্ট রয়েছে ফরেইন কান্ট্রির। তিনি অনলাইনেও বিভিন্ন দেশের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতেন। তাছাড়া সিংগাপুরের ঐ হাসপাতালের অনেক স্পেশালিষ্ট চিকিৎসক ছিলেন মুজিব স্যারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠজন। যা ঘটেছে হয়ে গেছে তা এক্সিডেন্ট।

একই ঘটনা ঘটেছে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর চিকিৎসার বেলায়। মেডিকেল এরর এ মৃত্যু। কই আমেরিকার রাস্তায় বাংগালী বা আমেরিকান কাউকে'তো ঝাড়ু, লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়নি। ইনফ্যাক্ট তাদের কাউকে তো হাসপাতালে গেটের কাছেই ভীড়তে দেয়নি পুলিশ, ভিতরে ঢুকে কিছু বলাতো দূরে থাক। সেসব দেশে মনগড়া, আবেগপ্রসুত কিছু করতে গেলে বা বলতে গেলে পুলিশ সাথে সাথে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বলবে, "এই নাও লাল কার্ড, তুমি তোমার দেশে যাও। ওখানে গিয়ে মাইর কর, মিছিল মিটিং যা খুশি তা করো বাপু"।

চিকিৎসা জটিলতায় বা ভুলে বা "মেডিকেল এরর" এ মৃত্যু অবশ্যই কাম্য নয়, কারো কাম্য হতে পারেনা। কেউ মেনেও নেবেনা। আমি না, আপনি না, কেউ না। তারপর ও এটা আছে, হয়ে যায়, ভবিশ্যতেও হয়ত হবে। কারন ঐ যে বললাম ডাক্তার রাও মানুষ। কিন্তু মনে রাখবেন আন-এভয়ডেবল এ ইনসিডেন্স কেউ চায়না, যেমন ডাক্তার চাননা, তেমনি রোগী বা তার স্বজন।

একটা জিনিষ বলি, কোন চিকিৎসকই চাননা তার রোগীটির বিন্দু মাত্র ক্ষতি হোক। রোগীর সুস্থতা ডাক্তারের কাছে গর্বের বিষয়। তাছাড়া চিকিৎসক দের একটা থ্রিল থাকে কিভাবে কত সহজে রোগীর দেহটাকে রোগ মুক্ত করা যায়।

আরেকটি কথা চিকিৎসা সেবা একটি ইবাদত। ডাক্তার রাও এটা ইবাদত হিসেবেই নেন। তারপরও এসব ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূর্ঘটনা ঘটে যায়, ঘটে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে। তাই বলে কি আপনি অবিশ্বাসী হয়ে ডাক্তার কে মেরে ফেলবেন, হাসপাতাল ভেংগে ফেলবেন, গুম করে ফেলবেন, ডাক্তার কে ধর্ষন করবেন?

আমরা দিন দিন কেনো এতো অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছি? মনে রাখবেন, আবারো বলছি কোনদিন কোন ডাক্তার ইচ্ছে করে বা জেনে শুনে বুঝে তার রোগীর ক্ষতি করে না। যেটুকু হয়ে যায় তা স্রেফ একটা এক্সিডেন্ট। তাদের মাধ্যমেও এক্সিডেন্ট হতে পারে। আর এর জন্যে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে মেডিকেল আইন আছে।

শেষ একটি কথা, মানুষের আয়ু নির্ধারিত। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বা ভগবান একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আপনাকে আমাকে পাঠিয়েছেন এবং সময় শেষ হলে তিনি আপনাকে উঠিয়ে নিবেন। তা হয়তো কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে। সুতরাং কিছু বলতে হলে আগে তাকেই বিনীত ভাবে বলুন। তার কাছে ক্ষমা চান। কারন তিনিইতো আপনাকে রোগাগ্রস্ত করে চিকিৎসক এর কাছে পাঠিয়েছেন। তা না করে অবিশ্বাসী মন নিয়ে কেবল ডাক্তার কে গালিগালাজ আর পেটালে কোন লাভ হবেনা। আপনি হয়তো বলবেন ডাক্তার কে পেটালে তারা সতর্ক হবে, ভুল কম হবে। কিন্তু আপনার ধারনা নিতান্তই মুর্খামি।

এভাবে ডাক্তার পেটাতে থাকলে, ডাক্তারের প্রতি অবিশ্বাস বাড়তে থাকলে,কিংবা কৌশলে বাড়াতে থাকলে, মানুষ পঞ্চাশ বা একশো বছর পর আর ডাক্তারি পড়তে আসবেনা। এতে ক্ষতি আমার, আপনার বা আমাদের অনাগত সন্তানদেরই হবে। (নিজস্ব ভাবনা)

লেখকঃ ডা. মো. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
(ডি এম সি, কে-৫২)

Post a Comment

Previous Post Next Post