কোহলি দাড়ি (নববধুর বায়ুচরা)



ডা. মোঃ সাঈদ এনাম: চোখ দুটো পুড়া ইটের মতো লাল করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে কিছু একটা আউড়ে যাচ্ছে, তা আমার কর্ণকুহরে মৃদু আঘাত করলেও এর শান এ নযুল পেলুম না। পাঠশালার ইংরাজ পণ্ডিত মশাইয়ের মতো চশমার উপর দিকে তাকিয়ে তরুণীটিকে বললাম,
কি হয়েছে। অমন করে রেগেছেন কেনো?

মেয়েটির বয়স কুড়ির কাছাকাছি। স্বামীর ও ওরকম। দুজনেই দেখতে সুন্দর। একই রকম লম্বা, ফর্সা "নাচিকামোটা" না চিকন না মোটা। নাচিকামোটা শব্দটি কলেজে পড়াকালীন আমাদের বন্ধু মহলের এক আড্ডায় আব্বাস ওরফে গাবগাছ তার প্রেমিকার বর্ণনা তুলে ধরতে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো। সেই থেকে শয়নে, স্বপনে, চলনে বলনে এমন কি বর বা কনে কাউকে দেখতে কাউকে কিছু ইংগিত করে বলতে আমরা নাচিকামমোটা শব্দটি ব্যবহার করি।

ছেলেটির ফর্সা গোলগাল মুখটিতে কুচকুলে কালো দাড়ি ঝুলে। সুন্নাতি দাড়ি না। অনেকটা শ্রীলংকার মানচিত্রের মতো কোণাকোণি করে কাটা, ফ্রেঞ্চ কাটের মতো। হালের তরুন দের মধ্যে ইদানীং এ স্টাইলে যৎ সামান্য ক'টা দাড়ি রাখা একটা ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে তা তাকে ছাগলের মতো লাগুক আর রামছাগলের মতো।

সেদিন আমার এক ভাগ্নেকে ডেকে বললাম, "ঔষধ কোম্পানি কিছু ফোম শেভ দিয়ে গেছে। ডেট এক্সাপায়ার্ড হয়ে যাবে। লাগলে কিছু নিয়ে যা। মুখেতো রামছাগলের লেজের মতো জংলী পাকিয়েছিস। এটা কি, রাখলে সুন্দর করে রাখ। মুখ ভর্তি সুন্নতি দাড়ি, কত সুন্দর লাগে দেখতে"। 
তা না সে বললো, 
"না মামা। রামছাগলের লেজ না, এটা বিরাট কূহলী স্টাইল। ঐ যে আপনার প্রিয় টিমের ব্যাটসম্যান"। বললাম, বুঝছি বিরাট কলি কাল যে চলে আসছে সে আমি তোদের দেখেই বুঝি"।

সে বললো, "আরে মামা বিরাট কলি কাল না বলো কোহলী কাল। ইন্ডিয়ার বিরাট কুহলি এ ফ্যাশনের উদ্যোক্তা। একে বলে কুহলি দাড়ি। ও তুমি বুঝবানা"।

বললাম, "দেখিস কোনদিন আবার ফেইস বুকে দাড়ি মাখা কুহলির ছবি দিয়ে বলে বসিস না, অবশেষে ইসলাম ধর্মের সুশীতল ছায়ায় শুয়ে পড়লেন বিরাট কুহলী। তুরা পারিসও বটে। মায়ানমারের অং সাং সুচী কে তো প্রতিবছর একবার হিজাব পরিয়ে মুসলমান বানাস। না জানি বেচারি সেই অভিমান থেকে কিনা সব রাগ রুহীংগা মুসলিম শিশুদের উপর ঝাড়লো। আহা মায়ের কোল থেকে শিশু কে কেড়ে নিয়ে কে কি নির্মম ভাবে জবাই করে করে মারলো সুচির দেশের সামরিক বাহিনী। আর অসহায় মা'গুলোকে কে শেষে ধর্ষন করে পুড়িয়ে মেরে করলো হায়েনার মতো উল্লাস। এই হলো অহিংস ধর্ম আর জীবে দয়া দেখানো নমুনা, ভাগ্যিস মহামানব গৌতম বুদ্ধ বেঁচে নেই।

যাহোক জিগ্যেস করলাম, "রেগে আছেন কেনো ম্যাডাম"। 
উত্তরে নেহায়েত কমবয়সী তরুন স্বামী কিছু একটা বলতে চাইলো, অমনি মেয়েটি থামিয়ে দিয়ে বললো,"খবরদার কোন কথা বলবানা। বলেছো হাটু ব্যাথার ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসবা, এনেছো সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে। আমি কি পাগল। আমার কি ব্রেইনে সমস্যা। আজ বাসায় যেয়ে নেই। দেখাবোনে মজা..,হু...ম.."।

তার হু...ম বলার ভংগিমায় যেকারো বুকে কাঁপন ধরে যাবে।

ছেলেটি চুপ। একেবারে চুপ। ছেলেবেলার মার্বেল খেলার মতো, নট নড়ন চড়ন, নো ধুনু মুনু। 
চুপ হবারই কথা। স্ত্রীর এমন ধমকের উত্তরে কেউ কিছু বলবে এমন বুকের পাটা এ ধরাতে খুব কম স্বামীদেরই আছে।

"ঠিক আছে জান। এই আমি চুপ করলাম। তুমিই বলো তুমার কি সমস্যা। কেনো তুমি রেগে আছো। মাথা ছুয়ে কিরা কাটলাম আমি আর একটি কথাও বলবো না। তবুও ওভাবে তাকিওনা প্লিজ। দাত কিড়িমিড়ি করোনা সোনা, ভয় লাগে..."। স্বামী কাতর হয়ে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলেই আবার চুপ।

কিছুক্ষণ সুনসান নিরবতা চেম্বারে।

বৈশাখের শুরুতেই চেম্বারে স্বামী-স্ত্রীতে এমন কাল বৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস আঁচ করে আমি এসিস্ট্যন্ট কে ইশারা করলাম বাইরে যেতে, পাছে তাদের মধ্যে হয়ে যায় এমন কিছু....। তাছাড়া ব্যক্তিগত কিছু আলাপের প্রয়োজনীয়তাও ছিলো। আর এর উত্তরে যদি বেফাঁস কিছু বলে বসেন স্ত্রী। তাহলেওতো বেচারার পহেলা বৈশাখ একেবারে রিয়েল পান্তাভাত হয়ে যাবে, এমনিতে কথাবার্তায় স্ত্রী অলরেডি পেনাল্টি বক্সে ঢুকে টুক টাক করছেন।

সেদিন এক কাপলের সেক্সুয়েল হিস্ট্রি নিতে স্বামী স্ত্রীতে বেঁধে গেলো ঝগড়া। এ বলে ওর সমস্যা, ও বলে এর। বহু কস্টে দুজন শান্ত করে মিলমিশ করে বুঝিয়ে বললাম। সাইকোসেক্সুয়েল প্রবলেম গুলো খুবই সাধারণ। ফার্স্ট নাইট ইম্পোট্যান্সি বলে একটা টার্ম ই আছে খুব প্রচলিত । এটা মামুলি। স্রেফ একটু সাইকোথেরাপি দিলেই কাজ হয়। তা না করে কবিরাজ, পীর ফকিরি আর ফুটপাতের দাওয়াই শ্রীপুরের বড়ি (ফ্লুপেনথিক্সল+মেলিট্রাসিন) খেয়ে খেয়ে সমস্যাটিকে স্থায়ী করে ফেলেন কেউ কেউ। শেষতক বিয়েই ভেংগে যায়। এসব রোগের সমাধান লজ্জা বা দোষাদোষ এ হয় না। পারস্পরিক সহানুভুতি আর ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হয়।

একটু ইজি করতে বললাম, কেমন আছেন?

"ভালো ছিলামতো। রাত্রে পড়ে গিয়ে হাটুতে একটু ব্যাথা পেয়েছি । সে জন্যে বলেছিলাম হাটু ব্যথার ডাক্তারের কাছে যাবো। আর তিনি নিয়ে এসেছেন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে। আজ হবে। আজ উনার হবে। বাসায় যেয়ে নেই। তারপর না বুঝবেন। কত ধানে কত চাল...", আবারো দাতগুলো ভয়ংকর ভাবে কিড়মিড়ি করতে লাগলেন তিনি। কটকট শব্দ আসছিলো।

ছেলেটি মাথা নিচু করে মুখ টিপে টিপে হাসছে। আমি নিজে কিছুটা শংকিত ছিলাম আমার সামনেই কিছু একটা হয়ে যায় কিনা। আহারে দুঃখ লাগলো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে, বৈশাখের শুরুতেই কি কাল বৈশাখী পেয়ে বসলো ছেলেটাকে।

তরুনীকে আরোও সহজ করার মওকা খুজছিলাম। সে ভীষণ উত্তেজিত, ভায়োলেন্ট। বিশেষ করে তার দাঁত কিড়মিড় করাটা রীতিমত হিম হয়ে যাবার মতো। এরকম ভায়োলেন্ট সাইকিয়াট্রিতে ট্রেনিং এর সময় একবার পেয়েছিলাম। এমন ভায়োলেন্ট এবং আউট যে, এক তরুন ইন্টার্ন কে "ভাইয়া তুমি খুব সুন্দর" বলে ঝাপটে ধরেছিলেন এক মোড ডিসঅর্ডারের তরুণী।

তা কিভাবে ব্যাথা হাটুতে পেলেন?

"ঐতো উনার জন্যে। রাতে কিনা কি বলেছিলাম মনে নেই, আর অমনি তিনি বাসা থেকে রাগ কিরে বাইরে চলে গেলেন। আর ফেরার নাম নেই। রাত একটা। নতুন বউ ঘরে রেখে কেউ এভাবে এতো রাত বাইরে থাকে। আমি কি কম সুন্দর, সবাই আমাকে দিপিকা পাডুকান ডাকে। তাছাড়া তিনি খেয়েও যাননি। বেচারা ক্ষিধের জালায় মরবে। তাই ভেবে ভেবে এক সময় তার মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে হাটুতে ব্যাথা পাই।

"নতুন বিয়ে আপনাদের বুঝি? খুব ভালোবাসেন স্বামী কে তাইনা..."?

"হ্যা। স্বামীকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। তাকে ভালোবাসবো নাতো কি আপনাকে ভালোবাসবো? খুব ভালো মানুষ। তবে একটু স্টাইলিস্ট। এই দেখেন না দাড়ি রেখেছেন। সুন্দর মুখটা কেমন রাম ছাগলের মতো। দাড়ি রাখা সুন্নত। নবীজি দাড়ি রাখতে বলেছেন। কিন্তু দেখেন তিনি কি দাড়ি রাখছেন। ছি ছি ছি... এটা দাড়ি হলো। কুহলি না কোকিল কার মতো করে রাখছেন, দেখতে একবারে কোকিলের লেজের মতো লাগছে। ইস ধবধবে সুন্দর সাদা মুখটা একেবারে কালো হয়ে গেছে কোকিল দাড়িতে"

"ম্যাডাম, কোকিল নয়, কোহলি। বিরাট কোহলি। ইন্ডিয়া ক্রিকেট টিমের একজন ভালো খেলোয়াড়। শুনেছি সেই এই ফ্যাশনের উদ্যোক্তা"

"ও....সেটা। তো অই কোহলি ব্যাটাকি মুসলমান.."?

না..

তাহলে দাড়ি রাখছে কেনো?

আমি সেটা জানিনা।

"কেনো জানেন না? আপনি না ডাক্তার। ডাক্তার রাতো সব জানে। আমার বড় ভাই ডাক্তার.."

আমার সাথে এমন মার মার কাট কাট জেরাতে ছেলেটি চুপি চুপি হাসছিলো। তবে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাথাটা নিচু করে ঠোঁটে ঠোট চেপে, পাছে স্ত্রী দেখে ফেলেন।

"দ্যাখেন দ্যাখেন আবার হাসছেন। আজ রাত দিবোনা.......দিবোনে সব দাড়ি কেটে, তখন কোত্থেকে হাসি দেখবো..."

আচ্ছা তা না হয় দিলেন, কিন্তু আপনি রেগে আছেন কেনো? একটু শান্ত হোন। ঔ কোহলি দাড়ী কি সমস্যা..?

"আর বলবেন না। আমি পর্দানশীল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই তিনি আমার পিছু লেগেছেন। আমাকে বোরকা পরতে দেননা নেকাব পরতে দেননা। এই দেখেন আজ আমাকে হিজাব পরতে দেননি। এই যে রাস্তা ঘাটের এতো পরপুরুষ আমাকে দেখলো এর গুনাগার কে হবে? উনি? না আমি? 
উনি হলেও তো সেই আমারই সমস্যা। রোজ হাশরে ফেরেশতারা যখন এই গোনাহের জন্যে উনাকে দোযখের দিকে টেনে নিয়ে যাবে তখন আমি কি চুপ থাকবো? আপনি বলেন? তখন তো সেই আমাকেই কিছু সোয়াব ধার দিয়ে উনাকে দোযখ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাইনা....?"

"ঠিক। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি উনাকে বলে দিবো। উনি যাতে আর এরকম গোনাহের কাজ না করেন"

"জ্বী স্যার।আপনি বলে দিবেন..."

"আচ্ছা আমি কি আপনার হাসবেন্ডের সাথে একটু একা কথা বলতে পারি? বেচারা সেই কখন থেকে চুপচাপ একা বসে আছেন আপনার ভয়ে..."

"না না। কিসের একা, কেনো একা? একা কথা বললেই তো উনি বলবে, আমি বেশি কথা বলি।আমি রাগারাগি করি। ভাংচুর করি। আমি পাগল হয়ে গেছি। জানেন কাল উনি এইসব কথা আমার বাবাকে বলেছেন। বাবা আমাকে বলেছেন, আজই নিয়ে যাবেন। আমি যাবো না। আমি উনাকে ছাড়া কোথাও যাবোনা। এঁ... এঁ... এঁ....আমি যাবোনা। বলে মেয়েটি এবার কান্না জুড়ে দিলো..."

"ওকে ওকে, কাঁদবেন না। কেউ আপনাকে নিয়ে যাবেনা। আচ্ছা বলুনতো আপনারা কি নতুন বিয়ে করেছেন?

জ্বী। দুই সপ্তাহ হলো..।

পছন্দের বিয়ে?

না..

তাহলে কিসে সমস্যা হয়ে গেলো হঠাৎ..?

কোন সমস্যা নেই..

"উনারা সবাই খুব ভালো। ভাইবোন তেরোজন। উনার বড় আট জন ছোট চারজন। সবাই গিজ গিজ করে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা আশে পাশে। গত দুই সপ্তাহ যাবৎ এক ফোটা ঘুমাতে পারিনি দুজনে। ভালো করে কথাও বলতে পারিনি। আমিও না, উনিও না। দ্যাখেন দ্যাখেন উনি কেমন শুকিয়ে গেছেন। 
এটা সমস্যা না। সমস্যা হলো না ঘুমালে আমার মাথা ঠিক থাকেনা। মেজাজ গরম হয়ে যায়। মাথায় বায়ুচরে যায়। আমার আবার বায়ুচরা রোগের সমস্যা আছে। এটার জন্যে গত এক বছর যাবৎ ঔষধ খাই। 
বাবা বিয়ের সময় উনাকে ডেকে বার বার বলে দিয়েছিলো, আমাকে যাতে রোজ ঔষধ খাওয়ায়। কিন্তু কি করবো। বিয়ের পর থেকে যে ঝামেলা শুরু হইছে। দুজনে একসাথে কোথাও বসতেই পারলাম না। এ আসে তো ও আসে। ইস এতো ঝামেলা জানলে বিয়েই করতাম না। 
আর সেই ঝামেলায় পড়ে পড়ে উনি আমাকে ঔষধ খাওয়ান নাই। টানা সাত দিন ঘুমাই নি। আর এজন্যে মেজাজটা একটু গরম হয়ে গেছে...,তার উপর উনি আবার রাখছেন কোকিল দাড়ি। নামাজ রোজার খবর নাই, দাড়ি নিয়া টানাটানি.... " তিনি চুপ হলেন।ল এবার।

ছেলেটি এবার সাহস করে মুখ খুললো, 
"স্যার একটু মেজাজ গরম না। টানা দুইদিন থেকে উনি কেবল কথা বলেই যাচ্ছেন বলেই যাচ্ছেন। সব কিছুতে উনার মতামত ই ঠিক। কেউ উনার বিরুদ্ধে গেলেই রেগে যাচ্ছেন। 
কাল রাতে রাগ করে দুটো মোবাইল ভাঙছেন, গ্লাস ছুড়ে উনার এল ই ডি টিভি ভাঙছেন। আমাকে তেড়ে আসছেন মারতে। আমি দৌড়ে বেঁচেছি। পরে আবার গলা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা টমা চেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। এই রাগ, এই কান্না। কি যে হলো কিছুই বুঝতে পারছিনা...,তাই শ্বশুর আব্বাকে জানিয়েছিলাম একটু, তিনি...."

"তুমি থামবে...., ভালো হবেনা কিন্তু, এই তুমি কোকিল দাড়ি রাখছো কেনো, হুম নামাজ পড়োনা কেনো...দোযখে গেলে তখন কি হবে..?

"আচ্ছা জান, আমি আজই দাড়ি কেটে ফেলবো, এই যে স্যারের সামনে প্রমিজ করলাম। এবার তুমি থামো.." ছেলেট হাত জোড় করলো।

"না, তুমি দাড়ি কাটবানা। কোকিল দাড়ি কে তুমি নবীর সুন্নতের মতো করে রেখে দিবা। নামাজ পড়বা...ঠিক"

"ওকে জান, ওকে। সব ঠিক। তুমি যা বলো সব ঠিক। এবার একটু ঠান্ডা হও..."

"ঠিক আছে। থামবো, কিন্তু তুমি আমার আব্বাকে টেলিফোনে কেনো বলছো আমাকে নিয়ে যেতে...,তুমি উনা এক্ষুনি ফোন করে আসতে নিষেধ করো। আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবোনা..."

"জানু আই এম সরি। আমার ভুল হইছে। আমি আসলে তোমার সিচুয়েশন টা শ্বশুর আব্বাকে বলছিলাম। আর কিছু না। তিনিই বললেন তোমাকে তাড়াতাড়ি সাইকিয়াট্রসিস্ট এর কাছে নিয়ে যেতে। কারন তোমার মোড ডিসওর্ডার না বায়ুচরা কি এক সমস্যা আছে। বছরে দুইবার দেখা দেয়। বৈশাখের শুরুতে আর অগ্রহায়নে। সেজন্যে তুমি ঔষধ ও খাচ্ছিলে জানু...."

"ও এই কথা। জামাই শ্বশুর মিলে আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছো। আমি পাগল। দাঁড়াও আজ হবে, আজ বাসায় যাই....", বলে আবারো দাত কিড়মিড়ি করতে লাগলেন তরুনী।

"আচ্ছা আচ্ছা, ম্যাডাম একটু থামেন। আমি দেখছি..., আর বকবেন না উনাকে...."। আমি থামাতে চাইলাম।

সদ্য বিবাহিত তরুনীটির মানসিক রোগের ক্লু'টি ইতোমধ্যে আমি পেয়ে গেছি বলা যায়। একে বাই পোলার মোড ডিসওর্ডার বলে। নিয়মিত ঔষধ খেতে হয়। মেয়েটি ঔষধ খাচ্ছিলো। কিন্তু বিয়ের ঝামেলা, অঘুমা সবকিছু মিলিয়ে রোগের সিম্পটম ফ্ল্যায়ার আপ হয়েছে।

"আপনারা দুজন ই খুবই ভালো। একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসেন। সমস্যা হয়ে গেছে বিয়ের ঝামেলায় আপনার যে ঔষধ গুলো চলতো সেগুলো খাননি, সাম হাও। এজন্য আপনার মেজাজ একটু চড়েছে এই যা। আপনার মারাত্মক কোন সমস্যা না। কে বলেছে ওসব বায়ুচরা... "

"বিয়ের সময় আমার বাবা উনাকে বলেছিলো বার বার আমাকে যাতে রোজ রোজ ঔষধ খাওয়ায়। উনিইতো খাওয়ায় নি। উনি কি আমাকে ঔষধ খাওয়ানোর চিন্তায় আছেন? উনি আছেন উনার কোকিল দাড়ি নিয়ে।

সারাদিন দাড়িতে খালি জেল মাখেন, আর কেঁচি দিয়ে কেটে কেটে কোকিলের লেজের মতো লম্বা করেন। যত বলি দাড়ি রাখলে কাটতে নেই, রাখলে নবীজীর মতো রাখতে হবে। কিন্ত কে শুনে কার কিথা। ফর্সা সুন্দর মুখটা কালো কোকিলের লেজের মতো সাজিয়ে রাখছেন,দ্যাখেন.., দাড়ান না। আপনি বলেন স্যার, দাড়ি নিয়ে স্টাইল ফ্যাশন করা কি ঠিক? আজ রাত আসুক। বাসায় যাই, দিবোনে কোকিল দাড়ির বারোটা বাজিয়ে..."

তরুন টি কিছু বলতে চাইলো। আমি ইশারা করে চুপ থাকতে বললাম। বিয়ে ও তার পরে নানান স্ট্রেস এ ওর মোড ডিসওর্ডার রোগ টির সিম্পটম গুলো কিছুটা ফিরে এসেছে।

"ওকে। ম্যাডাম। আপনি যা চান তাই হবে। সেটা আপনারা দুজন বাড়িতে গিয়ে রাতে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর মাধ্যমে করবেন। আপাতত আমার একটা রিকুয়েস্ট আপনি এক্ষুনি দুটো ঔষধ খান। বাই দা বাই, ভালো হয় আপনি যে ঔষধ খাচ্ছিলেন ওটা খেলে। কি ঔষধ খেতেন নামটা কি মনে আছে....?

"জ্বী। সোডিয়াম ভেলপ্রোয়েট এন্ড ভেলপ্রয়িক এসিড কম্বিনেশন, ৩০০ মিগ্রা। দিনে দুই বার...আর ক্লোনাজিপাম এক মি গ্রা রাতে একবার..."

"গুড গুড। ভেরী গুড। আপনার মেমোরি খুব শার্প.."

"হ্যা শার্প হবেনা কেনো। আমি ম্যাথম্যাটিকস অনার্সে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। আর কলেজের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন। আমাকে দিপিকা পাডুকান ডাকে সবাই। কেনো লাগেনা দেখতে..."

"শিওর শিওর। আলবাত লাগে। তাহলে যান ওটাই করুন, ওষুধ খান এখন। আমি সিস্টার কে বলে দিচ্ছি। আর ভালো হয় যদি একটা ঘুমের ইনজেকশন এখনই নিয়ে নেন..."

"ঠিক আছে,আপনি যখন বলছেন আমি খাবো। কিন্তু আমি বাবার বাড়ি যাবোনা। উনি আমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন। আমার বাবা আসতেছেন। আমি যাবোনা, আমি উনাকে ছাড়া কোথাও যাবোনা। এ.. এ... এ... বলে আবার মেয়েটি কাঁদতে লাগলো..."

"জানু জানু আমার জান।কেঁদোনা। আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। বাবা তোমাকে নিয়ে যাবেন না। তুমি কেঁদোনা প্লিজ। এটা স্যারের চেম্বার। চলো তোমাকে এক্ষুনি ঔষধ খাওয়াই..."

"তুমি খাইয়ে দিবাতো..."

অফকোর্স...প্রয়োজনে আমিও খাবো।

না না তুমি খাবেনা, খেলে আমার মতো হয়ে যাবে।

ঠিক আছে। আমি খাবোনা। খাইয়ে দিবো।

রোজ খাইয়ে দিবাতো?

আল্লাহর কিরা, গড প্রমিজ...

কোকিলা দাড়ি কাটবাতো?

এক্ষুনি কাটবো। স্যার আপনার কাছে ব্লেড আছে? এক্ষুনি সাফ করি....

আমি হেসে বললাম, "না ভাই। লাগলে রাতে কাটেন। এখন ঔষধ খাওয়ান..."

জ্বী স্যার এক্ষুনি খাওয়াচ্ছি।

আর শুনেন খবরদার আমাকে না জানিয়ে ঔষধ বন্ধ করবেন না, একেবারে আগামী পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত কিন্তু। রোগটা এপিসোডিক। পারলে ক'দিনের জন্যে হানিমুনে যান। মনে থাকবে?

"হ্যা স্যার। শিওর, শিওর। আর ভুল হবেনা..."

তরুনটি দুহাতে তার স্ত্রীকে ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার জোয়ার মুগ্ধ হবার মতো। বিশেষ করে ছেলেটির ধৈর্য, উদারতা প্রশংসনীয়। মানসিক রোগ গুলোকে অবহেলা নয় এভাবে ভালবাসা আর যত্নেই তো ভালো করা যায়।


লেখক: ডা. মো. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
ডি এম সি (কে-৫২)


ডা. মো. সাঈদ এনাম: চোখ দুটো পুড়া ইটের মতো লাল করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে কিছু একটা আউড়ে যাচ্ছে, তা আমার কর্ণকুহরে মৃদু আঘাত করলেও এর শান এ নযুল পেলুম না। পাঠশালার ইংরাজ পণ্ডিত মশাইয়ের মতো চশমার উপর দিকে তাকিয়ে তরুণীটিকে বললাম,
কি হয়েছে। অমন করে রেগেছেন কেনো?

মেয়েটির বয়স কুড়ির কাছাকাছি। স্বামীর ও ওরকম। দুজনেই দেখতে সুন্দর। একই রকম লম্বা, ফর্সা "নাচিকামোটা" না চিকন না মোটা। নাচিকামোটা শব্দটি কলেজে পড়াকালীন আমাদের বন্ধু মহলের এক আড্ডায় আব্বাস ওরফে গাবগাছ তার প্রেমিকার বর্ণনা তুলে ধরতে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো। সেই থেকে শয়নে, স্বপনে, চলনে বলনে এমন কি বর বা কনে কাউকে দেখতে কাউকে কিছু ইংগিত করে বলতে আমরা নাচিকামমোটা শব্দটি ব্যবহার করি।

ছেলেটির ফর্সা গোলগাল মুখটিতে কুচকুলে কালো দাড়ি ঝুলে। সুন্নাতি দাড়ি না। অনেকটা শ্রীলংকার মানচিত্রের মতো কোণাকোণি করে কাটা, ফ্রেঞ্চ কাটের মতো। হালের তরুন দের মধ্যে ইদানীং এ স্টাইলে যৎ সামান্য ক'টা দাড়ি রাখা একটা ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে তা তাকে ছাগলের মতো লাগুক আর রামছাগলের মতো।

সেদিন আমার এক ভাগ্নেকে ডেকে বললাম, "ঔষধ কোম্পানি কিছু ফোম শেভ দিয়ে গেছে। ডেট এক্সাপায়ার্ড হয়ে যাবে। লাগলে কিছু নিয়ে যা। মুখেতো রামছাগলের লেজের মতো জংলী পাকিয়েছিস। এটা কি, রাখলে সুন্দর করে রাখ। মুখ ভর্তি সুন্নতি দাড়ি, কত সুন্দর লাগে দেখতে"। 
তা না সে বললো, 
"না মামা। রামছাগলের লেজ না, এটা বিরাট কূহলী স্টাইল। ঐ যে আপনার প্রিয় টিমের ব্যাটসম্যান"। বললাম, বুঝছি বিরাট কলি কাল যে চলে আসছে সে আমি তোদের দেখেই বুঝি"।

সে বললো, "আরে মামা বিরাট কলি কাল না বলো কোহলী কাল। ইন্ডিয়ার বিরাট কুহলি এ ফ্যাশনের উদ্যোক্তা। একে বলে কুহলি দাড়ি। ও তুমি বুঝবানা"।

বললাম, "দেখিস কোনদিন আবার ফেইস বুকে দাড়ি মাখা কুহলির ছবি দিয়ে বলে বসিস না, অবশেষে ইসলাম ধর্মের সুশীতল ছায়ায় শুয়ে পড়লেন বিরাট কুহলী। তুরা পারিসও বটে। মায়ানমারের অং সাং সুচী কে তো প্রতিবছর একবার হিজাব পরিয়ে মুসলমান বানাস। না জানি বেচারি সেই অভিমান থেকে কিনা সব রাগ রুহীংগা মুসলিম শিশুদের উপর ঝাড়লো। আহা মায়ের কোল থেকে শিশু কে কেড়ে নিয়ে কে কি নির্মম ভাবে জবাই করে করে মারলো সুচির বাহিনী। আর অসহায় মা'গুলোকে কে শেষে ধর্ষন করে পুড়িয়ে মেরে করলো হায়েনার মতো উল্লাস। এই হলো অহিংস ধর্ম আর জীবে দয়া দেখানো নমুনা, ভাগ্যিস মহামানব গৌতম বুদ্ধ বেঁচে নেই।

যাহোক জিগ্যেস করলাম, "রেগে আছেন কেনো ম্যাডাম"। 
উত্তরে নেহায়েত কমবয়সী তরুন স্বামী কিছু একটা বলতে চাইলো, অমনি মেয়েটি থামিয়ে দিয়ে বললো,"খবরদার কোন কথা বলবানা। বলেছো হাটু ব্যাথার ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসবা, এনেছো সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে। আমি কি পাগল। আমার কি ব্রেইনে সমস্যা। আজ বাসায় যেয়ে নেই। দেখাবোনে মজা..,হু...ম.."।

তার হু...ম বলার ভংগিমায় যেকারো বুকে কাঁপন ধরে যাবে।

ছেলেটি চুপ। একেবারে চুপ। ছেলেবেলার মার্বেল খেলার মতো, নট নড়ন চড়ন, নো ধুনু মুনু। 
চুপ হবারই কথা। স্ত্রীর এমন ধমকের উত্তরে কেউ কিছু বলবে এমন বুকের পাটা এ ধরাতে খুব কম স্বামীদেরই আছে।

"ঠিক আছে জান। এই আমি চুপ করলাম। তুমিই বলো তুমার কি সমস্যা। কেনো তুমি রেগে আছো। মাথা ছুয়ে কিরা কাটলাম আমি আর একটি কথাও বলবো না। তবুও ওভাবে তাকিওনা প্লিজ। দাত কিড়িমিড়ি করোনা সোনা, ভয় লাগে..."। স্বামী কাতর হয়ে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলেই আবার চুপ।

কিছুক্ষণ সুনসান নিরবতা চেম্বারে।

বৈশাখের শুরুতেই চেম্বারে স্বামী-স্ত্রীতে এমন কাল বৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস আঁচ করে আমি এসিস্ট্যন্ট কে ইশারা করলাম বাইরে যেতে, পাছে তাদের মধ্যে হয়ে যায় এমন কিছু....। তাছাড়া ব্যক্তিগত কিছু আলাপের প্রয়োজনীয়তাও ছিলো। আর এর উত্তরে যদি বেফাঁস কিছু বলে বসেন স্ত্রী। তাহলেওতো বেচারার পহেলা বৈশাখ একেবারে রিয়েল পান্তাভাত হয়ে যাবে, এমনিতে কথাবার্তায় স্ত্রী অলরেডি পেনাল্টি বক্সে ঢুকে টুক টাক করছেন।

সেদিন এক কাপলের সেক্সুয়েল হিস্ট্রি নিতে স্বামী স্ত্রীতে বেঁধে গেলো ঝগড়া। এ বলে ওর সমস্যা, ও বলে এর। বহু কস্টে দুজন শান্ত করে মিলমিশ করে বুঝিয়ে বললাম। সাইকোসেক্সুয়েল প্রবলেম গুলো খুবই সাধারণ। ফার্স্ট নাইট ইম্পোট্যান্সি বলে একটা টার্ম ই আছে খুব প্রচলিত । এটা মামুলি। স্রেফ একটু সাইকোথেরাপি দিলেই কাজ হয়। তা না করে কবিরাজ, পীর ফকিরি আর ফুটপাতের দাওয়াই শ্রীপুরের বড়ি (ফ্লুপেনথিক্সল+মেলিট্রাসিন) খেয়ে খেয়ে সমস্যাটিকে স্থায়ী করে ফেলেন কেউ কেউ। শেষতক বিয়েই ভেংগে যায়। এসব রোগের সমাধান লজ্জা বা দোষাদোষ এ হয় না। পারস্পরিক সহানুভুতি আর ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে হয়।

একটু ইজি করতে বললাম, কেমন আছেন?

"ভালো ছিলামতো। রাত্রে পড়ে গিয়ে হাটুতে একটু ব্যাথা পেয়েছি । সে জন্যে বলেছিলাম হাটু ব্যথার ডাক্তারের কাছে যাবো। আর তিনি নিয়ে এসেছেন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে। আজ হবে। আজ উনার হবে। বাসায় যেয়ে নেই। তারপর না বুঝবেন। কত ধানে কত চাল...", আবারো দাতগুলো ভয়ংকর ভাবে কিড়মিড়ি করতে লাগলেন তিনি। কটকট শব্দ আসছিলো।

ছেলেটি মাথা নিচু করে মুখ টিপে টিপে হাসছে। আমি নিজে কিছুটা শংকিত ছিলাম আমার সামনেই কিছু একটা হয়ে যায় কিনা। আহারে দুঃখ লাগলো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে, বৈশাখের শুরুতেই কি কাল বৈশাখী পেয়ে বসলো ছেলেটাকে।

তরুনীকে আরোও সহজ করার মওকা খুজছিলাম। সে ভীষণ উত্তেজিত, ভায়োলেন্ট। বিশেষ করে তার দাঁত কিড়মিড় করাটা রীতিমত হিম হয়ে যাবার মতো। এরকম ভায়োলেন্ট সাইকিয়াট্রিতে ট্রেনিং এর সময় একবার পেয়েছিলাম। এমন ভায়োলেন্ট এবং আউট যে, এক তরুন ইন্টার্ন কে "ভাইয়া তুমি খুব সুন্দর" বলে ঝাপটে ধরেছিলেন এক মোড ডিসঅর্ডারের তরুণী।

তা কিভাবে ব্যাথা হাটুতে পেলেন?

"ঐতো উনার জন্যে। রাতে কিনা কি বলেছিলাম মনে নেই, আর অমনি তিনি বাসা থেকে রাগ কিরে বাইরে চলে গেলেন। আর ফেরার নাম নেই। রাত একটা। নতুন বউ ঘরে রেখে কেউ এভাবে এতো রাত বাইরে থাকে। আমি কি কম সুন্দর, সবাই আমাকে দিপিকা পাডুকান ডাকে। তাছাড়া তিনি খেয়েও যাননি। বেচারা ক্ষিধের জালায় মরবে। তাই ভেবে ভেবে এক সময় তার মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে হাটুতে ব্যাথা পাই।

"নতুন বিয়ে আপনাদের বুঝি? খুব ভালোবাসেন স্বামী কে তাইনা..."?

"হ্যা। স্বামীকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। তাকে ভালোবাসবো নাতো কি আপনাকে ভালোবাসবো? খুব ভালো মানুষ। তবে একটু স্টাইলিস্ট। এই দেখেন না দাড়ি রেখেছেন। সুন্দর মুখটা কেমন রাম ছাগলের মতো। দাড়ি রাখা সুন্নত। নবীজি দাড়ি রাখতে বলেছেন। কিন্তু দেখেন তিনি কি দাড়ি রাখছেন। ছি ছি ছি... এটা দাড়ি হলো। কুহলি না কোকিল কার মতো করে রাখছেন, দেখতে একবারে কোকিলের লেজের মতো লাগছে। ইস ধবধবে সুন্দর সাদা মুখটা একেবারে কালো হয়ে গেছে কোকিল দাড়িতে"

"ম্যাডাম, কোকিল নয়, কোহলি। বিরাট কোহলি। ইন্ডিয়া ক্রিকেট টিমের একজন ভালো খেলোয়াড়। শুনেছি সেই এই ফ্যাশনের উদ্যোক্তা"

"ও....সেটা। তো অই কোহলি ব্যাটাকি মুসলমান.."?

না..

তাহলে দাড়ি রাখছে কেনো?

আমি সেটা জানিনা।

"কেনো জানেন না? আপনি না ডাক্তার। ডাক্তার রাতো সব জানে। আমার বড় ভাই ডাক্তার.."

আমার সাথে এমন মার মার কাট কাট জেরাতে ছেলেটি চুপি চুপি হাসছিলো। তবে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাথাটা নিচু করে ঠোঁটে ঠোট চেপে, পাছে স্ত্রী দেখে ফেলেন।

"দ্যাখেন দ্যাখেন আবার হাসছেন। আজ রাত দিবোনা.......দিবোনে সব দাড়ি কেটে, তখন কোত্থেকে হাসি দেখবো..."

আচ্ছা তা না হয় দিলেন, কিন্তু আপনি রেগে আছেন কেনো? একটু শান্ত হোন। ঔ কোহলি দাড়ী কি সমস্যা..?

"আর বলবেন না। আমি পর্দানশীল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই তিনি আমার পিছু লেগেছেন। আমাকে বোরকা পরতে দেননা নেকাব পরতে দেননা। এই দেখেন আজ আমাকে হিজাব পরতে দেননি। এই যে রাস্তা ঘাটের এতো পরপুরুষ আমাকে দেখলো এর গুনাগার কে হবে? উনি? না আমি? 
উনি হলেও তো সেই আমারই সমস্যা। রোজ হাশরে ফেরেশতারা যখন এই গোনাহের জন্যে উনাকে দোযখের দিকে টেনে নিয়ে যাবে তখন আমি কি চুপ থাকবো? আপনি বলেন? তখন তো সেই আমাকেই কিছু সোয়াব ধার দিয়ে উনাকে দোযখ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাইনা....?"

"ঠিক। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি উনাকে বলে দিবো। উনি যাতে আর এরকম গোনাহের কাজ না করেন"

"জ্বী স্যার।আপনি বলে দিবেন..."

"আচ্ছা আমি কি আপনার হাসবেন্ডের সাথে একটু একা কথা বলতে পারি? বেচারা সেই কখন থেকে চুপচাপ একা বসে আছেন আপনার ভয়ে..."

"না না। কিসের একা, কেনো একা? একা কথা বললেই তো উনি বলবে, আমি বেশি কথা বলি।আমি রাগারাগি করি। ভাংচুর করি। আমি পাগল হয়ে গেছি। জানেন কাল উনি এইসব কথা আমার বাবাকে বলেছেন। বাবা আমাকে বলেছেন, আজই নিয়ে যাবেন। আমি যাবো না। আমি উনাকে ছাড়া কোথাও যাবোনা। এঁ... এঁ... এঁ....আমি যাবোনা। বলে মেয়েটি এবার কান্না জুড়ে দিলো..."

"ওকে ওকে, কাঁদবেন না। কেউ আপনাকে নিয়ে যাবেনা। আচ্ছা বলুনতো আপনারা কি নতুন বিয়ে করেছেন?

জ্বী। দুই সপ্তাহ হলো..।

পছন্দের বিয়ে?

না..

তাহলে কিসে সমস্যা হয়ে গেলো হঠাৎ..?

কোন সমস্যা নেই..

"উনারা সবাই খুব ভালো। ভাইবোন তেরোজন। উনার বড় আট জন ছোট চারজন। সবাই গিজ গিজ করে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা আশে পাশে। গত দুই সপ্তাহ যাবৎ এক ফোটা ঘুমাতে পারিনি দুজনে। ভালো করে কথাও বলতে পারিনি। আমিও না, উনিও না। দ্যাখেন দ্যাখেন উনি কেমন শুকিয়ে গেছেন। 
এটা সমস্যা না। সমস্যা হলো না ঘুমালে আমার মাথা ঠিক থাকেনা। মেজাজ গরম হয়ে যায়। মাথায় বায়ুচরে যায়। আমার আবার বায়ুচরা রোগের সমস্যা আছে। এটার জন্যে গত এক বছর যাবৎ ঔষধ খাই। 
বাবা বিয়ের সময় উনাকে ডেকে বার বার বলে দিয়েছিলো, আমাকে যাতে রোজ ঔষধ খাওয়ায়। কিন্তু কি করবো। বিয়ের পর থেকে যে ঝামেলা শুরু হইছে। দুজনে একসাথে কোথাও বসতেই পারলাম না। এ আসে তো ও আসে। ইস এতো ঝামেলা জানলে বিয়েই করতাম না। 
আর সেই ঝামেলায় পড়ে পড়ে উনি আমাকে ঔষধ খাওয়ান নাই। টানা সাত দিন ঘুমাই নি। আর এজন্যে মেজাজটা একটু গরম হয়ে গেছে...,তার উপর উনি আবার রাখছেন কোকিল দাড়ি। নামাজ রোজার খবর নাই, দাড়ি নিয়া টানাটানি.... " তিনি চুপ হলেন।ল এবার।

ছেলেটি এবার সাহস করে মুখ খুললো, 
"স্যার একটু মেজাজ গরম না। টানা দুইদিন থেকে উনি কেবল কথা বলেই যাচ্ছেন বলেই যাচ্ছেন। সব কিছুতে উনার মতামত ই ঠিক। কেউ উনার বিরুদ্ধে গেলেই রেগে যাচ্ছেন। 
কাল রাতে রাগ করে দুটো মোবাইল ভাঙছেন, গ্লাস ছুড়ে উনার এল ই ডি টিভি ভাঙছেন। আমাকে তেড়ে আসছেন মারতে। আমি দৌড়ে বেঁচেছি। পরে আবার গলা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা টমা চেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। এই রাগ, এই কান্না। কি যে হলো কিছুই বুঝতে পারছিনা...,তাই শ্বশুর আব্বাকে জানিয়েছিলাম একটু, তিনি...."

"তুমি থামবে...., ভালো হবেনা কিন্তু, এই তুমি কোকিল দাড়ি রাখছো কেনো, হুম নামাজ পড়োনা কেনো...দোযখে গেলে তখন কি হবে..?

"আচ্ছা জান, আমি আজই দাড়ি কেটে ফেলবো, এই যে স্যারের সামনে প্রমিজ করলাম। এবার তুমি থামো.." ছেলেট হাত জোড় করলো।

"না, তুমি দাড়ি কাটবানা। কোকিল দাড়ি কে তুমি নবীর সুন্নতের মতো করে রেখে দিবা। নামাজ পড়বা...ঠিক"

"ওকে জান, ওকে। সব ঠিক। তুমি যা বলো সব ঠিক। এবার একটু ঠান্ডা হও..."

"ঠিক আছে। থামবো, কিন্তু তুমি আমার আব্বাকে টেলিফোনে কেনো বলছো আমাকে নিয়ে যেতে...,তুমি উনা এক্ষুনি ফোন করে আসতে নিষেধ করো। আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবোনা..."

"জানু আই এম সরি। আমার ভুল হইছে। আমি আসলে তোমার সিচুয়েশন টা শ্বশুর আব্বাকে বলছিলাম। আর কিছু না। তিনিই বললেন তোমাকে তাড়াতাড়ি সাইকিয়াট্রসিস্ট এর কাছে নিয়ে যেতে। কারন তোমার মোড ডিসওর্ডার না বায়ুচরা কি এক সমস্যা আছে। বছরে দুইবার দেখা দেয়। বৈশাখের শুরুতে আর অগ্রহায়নে। সেজন্যে তুমি ঔষধ ও খাচ্ছিলে জানু...."

"ও এই কথা। জামাই শ্বশুর মিলে আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছো। আমি পাগল। দাঁড়াও আজ হবে, আজ বাসায় যাই....", বলে আবারো দাত কিড়মিড়ি করতে লাগলেন তরুনী।

"আচ্ছা আচ্ছা, ম্যাডাম একটু থামেন। আমি দেখছি..., আর বকবেন না উনাকে...."। আমি থামাতে চাইলাম।

সদ্য বিবাহিত তরুনীটির মানসিক রোগের ক্লু'টি ইতোমধ্যে আমি পেয়ে গেছি বলা যায়। একে বাই পোলার মোড ডিসওর্ডার বলে। নিয়মিত ঔষধ খেতে হয়। মেয়েটি ঔষধ খাচ্ছিলো। কিন্তু বিয়ের ঝামেলা, অঘুমা সবকিছু মিলিয়ে রোগের সিম্পটম ফ্ল্যায়ার আপ হয়েছে।

"আপনারা দুজন ই খুবই ভালো। একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসেন। সমস্যা হয়ে গেছে বিয়ের ঝামেলায় আপনার যে ঔষধ গুলো চলতো সেগুলো খাননি, সাম হাও। এজন্য আপনার মেজাজ একটু চড়েছে এই যা। আপনার মারাত্মক কোন সমস্যা না। কে বলেছে ওসব বায়ুচরা... "

"বিয়ের সময় আমার বাবা উনাকে বলেছিলো বার বার আমাকে যাতে রোজ রোজ ঔষধ খাওয়ায়। উনিইতো খাওয়ায় নি। উনি কি আমাকে ঔষধ খাওয়ানোর চিন্তায় আছেন? উনি আছেন উনার কোকিল দাড়ি নিয়ে।

সারাদিন দাড়িতে খালি জেল মাখেন, আর কেঁচি দিয়ে কেটে কেটে কোকিলের লেজের মতো লম্বা করেন। যত বলি দাড়ি রাখলে কাটতে নেই, রাখলে নবীজীর মতো রাখতে হবে। কিন্ত কে শুনে কার কিথা। ফর্সা সুন্দর মুখটা কালো কোকিলের লেজের মতো সাজিয়ে রাখছেন,দ্যাখেন.., দাড়ান না। আপনি বলেন স্যার, দাড়ি নিয়ে স্টাইল ফ্যাশন করা কি ঠিক? আজ রাত আসুক। বাসায় যাই, দিবোনে কোকিল দাড়ির বারোটা বাজিয়ে..."

তরুন টি কিছু বলতে চাইলো। আমি ইশারা করে চুপ থাকতে বললাম। বিয়ে ও তার পরে নানান স্ট্রেস এ ওর মোড ডিসওর্ডার রোগ টির সিম্পটম গুলো কিছুটা ফিরে এসেছে।

"ওকে। ম্যাডাম। আপনি যা চান তাই হবে। সেটা আপনারা দুজন বাড়িতে গিয়ে রাতে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর মাধ্যমে করবেন। আপাতত আমার একটা রিকুয়েস্ট আপনি এক্ষুনি দুটো ঔষধ খান। বাই দা বাই, ভালো হয় আপনি যে ঔষধ খাচ্ছিলেন ওটা খেলে। কি ঔষধ খেতেন নামটা কি মনে আছে....?

"জ্বী। সোডিয়াম ভেলপ্রোয়েট এন্ড ভেলপ্রয়িক এসিড কম্বিনেশন, ৩০০ মিগ্রা। দিনে দুই বার...আর ক্লোনাজিপাম এক মি গ্রা রাতে একবার..."

"গুড গুড। ভেরী গুড। আপনার মেমোরি খুব শার্প.."

"হ্যা শার্প হবেনা কেনো। আমি ম্যাথম্যাটিকস অনার্সে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। আর কলেজের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন। আমাকে দিপিকা পাডুকান ডাকে সবাই। কেনো লাগেনা দেখতে..."

"শিওর শিওর। আলবাত লাগে। তাহলে যান ওটাই করুন, ওষুধ খান এখন। আমি সিস্টার কে বলে দিচ্ছি। আর ভালো হয় যদি একটা ঘুমের ইনজেকশন এখনই নিয়ে নেন..."

"ঠিক আছে,আপনি যখন বলছেন আমি খাবো। কিন্তু আমি বাবার বাড়ি যাবোনা। উনি আমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন। আমার বাবা আসতেছেন। আমি যাবোনা, আমি উনাকে ছাড়া কোথাও যাবোনা। এ.. এ... এ... বলে আবার মেয়েটি কাঁদতে লাগলো..."

"জানু জানু আমার জান।কেঁদোনা। আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। বাবা তোমাকে নিয়ে যাবেন না। তুমি কেঁদোনা প্লিজ। এটা স্যারের চেম্বার। চলো তোমাকে এক্ষুনি ঔষধ খাওয়াই..."

"তুমি খাইয়ে দিবাতো..."

অফকোর্স...প্রয়োজনে আমিও খাবো।

না না তুমি খাবেনা, খেলে আমার মতো হয়ে যাবে।

ঠিক আছে। আমি খাবোনা। খাইয়ে দিবো।

রোজ খাইয়ে দিবাতো?

আল্লাহর কিরা, গড প্রমিজ...

কোকিলা দাড়ি কাটবাতো?

এক্ষুনি কাটবো। স্যার আপনার কাছে ব্লেড আছে? এক্ষুনি সাফ করি....

আমি হেসে বললাম, "না ভাই। লাগলে রাতে কাটেন। এখন ঔষধ খাওয়ান..."

জ্বী স্যার এক্ষুনি খাওয়াচ্ছি।

আর শুনেন খবরদার আমাকে না জানিয়ে ঔষধ বন্ধ করবেন না, একেবারে আগামী পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত কিন্তু। রোগটা এপিসোডিক। পারলে ক'দিনের জন্যে হানিমুনে যান। মনে থাকবে?

"হ্যা স্যার। শিওর, শিওর। আর ভুল হবেনা..."

তরুনটি দুহাতে তার স্ত্রীকে ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার জোয়ার মুগ্ধ হবার মতো। বিশেষ করে ছেলেটির ধৈর্য, উদারতা প্রশংসনীয়। মানসিক রোগ গুলোকে অবহেলা নয় এভাবে ভালবাসা আর যত্নেই তো ভালো করা যায়।


লেখক: ডা. মো. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
ডি এম সি (কে-৫২)

1 Comments

Previous Post Next Post