বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য


অনলাইন ডেস্কঃ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’—১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)। ফলে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

ইউনেসকোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা গত সোমবার প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তরে এ স্বীকৃতির কথা জানান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বৈশ্বিক গুরুত্ব আছে এমন ডকুমেন্টগুলোকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ তালিকায় স্থান দেওয়া হয়। ডকুমেন্টগুলো সংরক্ষণ এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনের জানার ব্যবস্থা করাই এর উদ্দেশ্য। তালিকায় স্থান দেওয়ার আগে এর গুরুত্ব বিষয়ে ইউনেস্কোকে সন্তুষ্ট হতে হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘বিশ্ব এখন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আরো বেশি জানতে পারবে। ’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। ওই ভাষণ আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য জনগণ ও পুরো জাতিকে প্রস্তুত হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এটি মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেওয়া অগণিত সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করেছে। ’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেশজুড়ে বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হয়।

এটি আজও বাঙালি জনগণের হৃদয় ও মননে প্রতিধ্বনিত হয়। এই ভাষণ আমাদের জনগণকে এখনো বিমোহিত করে। এটি আগামী প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে। ’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কোনো ডকুমেন্ট ইউনেসকোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে কী হবে না সে বিষয়টি নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিটি। গত ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর পরামর্শক কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। বর্তমানে ওই তালিকায় সব মহাদেশ মিলে ৪১৭টি ডকুমেন্ট রয়েছে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিল বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আবেদনপত্রে ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ তাঁর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। এমন একসময় তিনি ওই ভাষণ দিয়েছিলেন, যখন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা তাঁকে ক্ষমতা দিচ্ছিল না। ওই ভাষণে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।

আবেদনপত্রে আরো বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা গণহত্যা শুরু করলে বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। সেই রাতেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে টানা ৯ মাস তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে রাখলেও তাঁর ওই ভাষণ বাঙালি তরুণদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

ইতিহাসবিদ ও লেখক জ্যাকব এফ ফিল্ডের লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস : দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্ট্রি’ গ্রন্থে গত আড়াই হাজার বছরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী যুদ্ধকলীন বক্তৃতাগুলো স্থান পেয়েছে। সেখানে গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্থান পেয়েছে। উপনিবেশ পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার ব্যর্থতা কিভাবে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক, ভাষা বা ধর্ম গোষ্ঠীকে কিভাবে বিচ্ছিন্ন করে তার আদর্শ বর্ণনা রয়েছে ওই ভাষণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নতুন করে আন্তর্জাতিক সীমানা প্রণয়নের পর প্রথম সফল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমেই। বিশ্বজুড়ে যে দেশগুলো অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ এবং ভূখণ্ডের মধ্যে সব নৃগোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ আজও প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু তাত্ক্ষণিক সেই ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি লিখিত ভাষণ পড়েননি। তাঁর সেই ভাষণ অডিও এবং অডিও-ভিডিও (এভি) আকারে সংরক্ষিত আছে।

ইউনেসকোর স্বীকৃতির প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউনেসকোর স্বীকৃতি ছিল প্রত্যাশিত। আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন না একদিন এই ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। আজ ইউনেসকোর এই স্বীকৃতি আমাদের সেই বিশ্বাসকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ’

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণ ছিল অলিখিত। তিনি সারাজীবন যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। ’

বাণিজ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাঁকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তাঁর এই সতর্ক কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না’। ’’

বাণিজ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ‘পৃথিবীতে অন্য কোনো ভাষণ এতবার উচ্চারিত হয়নি, অন্য কোনো ভাষণ এতবার বাজানো হয়নি। অথচ এই ভাষণ আমরা একসময় ১৫ আগস্ট ও ৭ মার্চ বাজাতে পারিনি। বিএনপির শাসনামলে আমাদের তা বাজাতে দেওয়া হয়নি। মাইক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ’

তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গবন্ধু চারটি শর্ত দিয়েছিলেন—মার্শাল ল’ তুলে নেওয়া, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং পাকিস্তান বাহিনীর চালানো বর্বরতার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা। পাশাপাশি তিনি বাঙালি জাতিকে যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে কখনো বলেননি, আমাদের স্বাধীন করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করা হবে। এটি ছিল কৌশল। যেন ইয়াহিয়া খানরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী না বলতে পারে; পাকিস্তান ভাঙার দায় যেন বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ে না দিতে পারে। ’

Post a Comment

Previous Post Next Post