অনলাইন ডেস্কঃ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে
নির্যাতন, নিপীড়নের ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জাতিগত নিধনের
শিকার রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা গত শুক্রবার মিয়ানমার পুলিশের ৩১টি নিরাপত্তা
চৌকিতে একযোগে হামলা চালায়। এতে নিরাপত্তাবাহিনীর ১২ সদস্যসহ শতাধিক
রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটে। সশস্ত্র এই হামলার পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের
বিরুদ্ধে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী অভিযান শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
সহায়-সম্বলহীন
এই রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছুটছেন প্রতিবেশি বাংলাদেশের দিকে।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলি, মর্টার
শেল নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করছে দেশটির সেনাবাহিনী। আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা
গোলায় পুড়ছে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়-আবাসস্থলও। প্রাণে বাঁচতে
কাটাতারের বেড়া ভেদ করে নাফ নদের পাড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গার আর্তনাদ।
দল
বেধে ছোট্ট নৌকায় চেপে নাফ নদ পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে বাঁচার স্বপ্ন।
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের নিকটবর্তী নাফনদে নৌকাডুবে বৃহস্পতিবারও ১৯
রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর
বর্বরতায় নাফে ভাসছে রোহিঙ্গাদের মরদেহ, ডুবছে মানবতা।
রাখাইনের
মংডু থেকে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেছেন, তার তিন
ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। চোখের সামনেই এক ছেলেকে গলাকেটে হত্যা
করা হয়েছে। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে তার বাড়ি-ঘরে। স্ত্রী ও এক সন্তানসহ নাফ
নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে এসেছেন তিনি।
মার্কিন
প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, সৌদি আরবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের
স্বাধীনতাকামী সংগঠন রাখাইনের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ)
বিদ্রোহীরা গত সপ্তাহে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালায়। ওই সময়
সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে প্রবেশের চেষ্টা করে তারা। চলতি সপ্তাহের শুরুর
দিকে মিয়ানমার সরকার এআরএসএ’কে ‘চরমপন্থী বাঙালি সন্ত্রাসী’ সংগঠন বলে দাবি
করলেও পরে সুর পাল্টিয়ে আরাকানের স্বাধীনতাকামী এই সংগঠনকে ‘আরসা চরমপন্থী
সন্ত্রাসী’ সংগঠন বলে নতুন পরিচয় সামনে আনে।
গত
বছরের অক্টোবরে আত্মপ্রকাশ করা এআরএসএ বলছে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে
রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে সুরক্ষা দেয়া ও মুক্ত করাই তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
গত
শুক্রবার পুলিশি চৌকিতে হামলার পর থেকে রাখাইনে সরকারি বাহিনী ব্যাপক
অভিযান শুরু করে। সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত অভিযানে বিচারবহির্ভূত বেসামরিক
হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। রাখাইনে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশে কড়াকড়ি
রয়েছে, ফলে সেখানে কি ঘটছে তার পরিষ্কার কোনো চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
মিয়ানমার
কর্তৃপক্ষ বলছে, গত সপ্তাহের ওই হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৭৭ বিদ্রোহী,
নিরাপত্তাবাহিনীর ১২ সদস্য ও ১৪ বেসামরিক নিহত হয়েছে। তবে এই হতাহতের
পরিমাণ আরো বেশি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা।
মানবিক
সহায়তা কর্মীরা রাখাইনের রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, বুলেট ও আগুনের ভয়াবহ
ক্ষত তুলে ধরছেন। রোহিঙ্গারা বলছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নারী ও
তরুণীরা গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাদের হাজার হাজার বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ
করা হচ্ছে।
স্যাটেলাইট
ধারণকৃত ছবিতে রাখাইনের একশ কিলোমিটার এলাকার অন্তত ১০টি স্থানে
অগ্নিসংযোগের চিত্র উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। একই ধরনের চিত্র গত বছরের নভেম্বরেও দেখা যায় বলে
সংস্থাটি দাবি করেছে। গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনে সেনাবাহিনীর একই ধরনের
রক্তক্ষয়ী অভিযানে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ওই সময়
জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বলেন, রাখাইনে জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে
মিয়ানমার সরকার; যা মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।
গত
সপ্তাহে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাখাইনে
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে
রোহিঙ্গাদেরকে সেদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। তবে দীর্ঘদিন
সামরিক জান্তা শাসিত মিয়ানমারের বর্তমান সু চি নেতৃত্বাধীন সরকার কফি আনান
কমিশনের এই আহ্বানে সাড়া দেবে এমন কল্পনা করাও কঠিন।
সমাধান কোন পথে?
ইন্টারন্যাশনাল
ক্রাইসিস গ্রুপ এক বিবৃতিতে বলছে, রাখাইনের বর্তমান সংকট অনিবার্য এবং
অপ্রতিরোধ্য ছিল। ২০১২ সালের মুসলিম বিরোধী সহিংসতা ও গত বছর নতুন বিদ্রোহী
গোষ্ঠীর উত্থানের ফলে একটি বিষয়ে পরিষ্কার হয়েছে যে, রাখাইনের
অস্থিতিশীলতার সমাধানে রাজনৈতিক পদক্ষেপ দরকার, শুধুমাত্র নিরাপত্তা অভিযান
নয়। রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের উদ্বেগ মোকাবেলায় এটি জরুরি।
‘যদি তা না করা হয়, তাহলে রোহিঙ্গা ও বার্মিজ রাষ্ট্র, উভয়ের অবস্থাই আরো খারাপ হতে পারে।’
মিয়ানমারের
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পাঁচ বছরের মধ্যে এবারের ভয়াবহ সহিংসতা থেকে বাঁচতে গত
এক সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে জাতিসংঘের
শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার ইউএনএইচসিআরের
এক কর্মকর্তা বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, দুই দেশের সীমান্তের শূন্য
রেখায় এখনো ২০ হাজার রোহিঙ্গা আটকা আছে।
মাওলানা
খাইরুল আমিন নামের এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধ ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমসকে বলেন,
তিনি চিন কালির একটি অস্থায়ী শিবিরে বসবাস করছিলেন। সাম্প্রতিক সহিংসতার পর
এই শিবির পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী।
রোহিঙ্গা
এই বৃদ্ধ বলেন, আমাদের কাছে কোনো খাবার নেই। মংডু থেকে ২০ বছর বয়সী এক
তরুণ বলেন, তিনি তার বন্ধুদের সহ মংডুর পাহাড়ে রয়েছেন। তারা গাছ-পালার পাতা
খেয়ে বেঁচে আছেন।
রোহিঙ্গাদের পরিচয় কী?
রোহিঙ্গারা
বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত রাষ্ট্রহীন মুসলিম জাতি বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
সংস্থাটি বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে নির্যাতিত সংখ্যালঘু একটি
গোষ্ঠী হচ্ছে এই রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষার সঙ্গে
রোহিঙ্গাদের ভাষার মিল থাকায় সংখ্যালঘু সুন্নিপন্থী এই গোষ্ঠীকে ঘৃণা করেন
মিয়ানমারের বৌদ্ধরা। মিয়ানমারের এই বৌদ্ধরা এসব রোহিঙ্গাকে অবৈধ অভিবাসী
মনে করে। এমনকি মিয়ানমারে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে এলেও তাদের বাঙালি
হিসেবে ডাকে স্থানীয়রা।
রোহিঙ্গাদের
অধিকাংশই দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও
সে দেশের নাগরিকত্ব নেই তাদের। এছাড়া রোহিঙ্গাদের চলাচল ও কাজের ওপরও
নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, ২০১২
সালে দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর রাখাইন প্রদেশ থেকে এক লাখ ২০
হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়েছে। সমুদ্রপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা
পালাচ্ছে; এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।
১৯৮২
সালে মিয়ানমারে একটি আইন পাস হয়; কয়েক প্রজন্ম ধরে দেশটিতে রোহিঙ্গারা
বসবাস করে এলেও ওই আইনে তাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করা হয়। সেই
সময়ই তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের
দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন
প্রদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে। কয়েক দশক ধরে অব্যাহত নির্যাতনের মুখে
রোহিঙ্গাদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। বাংলাদেশের কক্সবাজারসহ বিভিন্ন
স্থানে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে বলে জানিয়েছে
ইউএনএইচসিআর।