শুভ্র দেব: তনয়া সিদ্দিকী (ছদ্ম নাম)। অভিজাত পরিবারের মেয়ে। তার সহপাঠী রোহানও অভিজাত পরিবারের সন্তান। দু’জনেই রাজধানীর নামি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শখের বসে সিসা টানতে গিয়ে এখন নেশা হয়ে গেছে এটি। এখন সিসা ছাড়া একদিনও চলে না। মেধাবী ছাত্র ইমাদ। একটি নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অভিজাত পরিবারের সন্তান ইমাদ থাকেন রাজধানীর বনানীতে। প্রথম প্রথম সহপাঠীদের সঙ্গে সিগারেট দিয়ে শুরু হয় আড্ডা। তারপর বনানীর একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে আসা-যাওয়া শুরু করেন। সেখানেই শুরু হয় সিসার হাতেখড়ি। এখন লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই। দিন-রাতের অধিকাংশ সময় কাটে সিসা বারে। শুধু তনয়, রোহান আর ইমাদ নন, রাজধানীতে উচ্চবিত্ত ঘরের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এখন সিসায় আসক্ত। সীসাসেবী একাধিক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তারা কেবল ফ্যাশনের জন্য সিসা সেবন করেন। সিসা সেবনে তাদের কোনো নেশা হয় না। শুধুমাত্র কিছুটা সময় বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করা যায়। রাজধানীর অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা ও বনানী এলাকায় রয়েছে অনেক সিসাবার। সরজমিন, কিছু সিসাবারে গিয়ে দেখা যায়, তরুণ-তরুণীরা বারে প্রবেশ করেই হারিয়ে যাচ্ছে অন্য জগতে। গাঢ় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। বদ্ধ রুমের আলো-আঁধারিতে তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা। টেলিভিশনের বড় পর্দায় বাজছে হিন্দি, বাংলা গান। ছোট ছোট টেবিলে সাত আটজন তরুণ-তরুণী গাদাগাদি করে বসে আছেন। সবাই একসঙ্গে করছেন সিসা সেবন। মুখভর্তি ধোঁয়াতে আরও আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে চারপাশ। চোখ জ্বালা পোড়া করছে। একই পাইপ হাত বদল হয়ে যাচ্ছে অন্য হাতে। সিসার টানে টানে খুঁজে পাচ্ছে তারা আনন্দ। এ যেন এক রঙ্গিন দুনিয়া।
অনুসন্ধান ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রু অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর উচ্চবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা এখন সিসাবারে আড্ডা দেয়। সেখানে বসে আড্ডার সঙ্গে চলছে সিসার নেশার উন্মাদনা। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বেশি সিসায় আসক্ত। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অনেকেই সিসাবারে সময় পার করছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে জমে উঠে আড্ডা। দেখতে অনেকটা দেশীয় হুঁক্কার আদলে তৈরি সিসার নেশা। জানা যায়, সেই মোগল আমল থেকে সিসার প্রচলন। মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন দেশে সিসা এখনও অনেক জনপ্রিয়। বিভিন্ন ফলের নির্যাস দিয়ে তৈরি হয় সিসার উপাদান। কিন্তু বাংলাদেশে এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। এদিকে সিসার বার এবং সিসায় আসক্ত তরুণ-তরুণীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সিটি করপোরেশন থেকে সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে নগরীর বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্টে দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে সিসাবার। যদিও রেস্টুরেন্ট মালিকরা সিসায় কোনো মাদকদ্রব্য মেশানো হয় না বলে দাবি করছেন। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক অভিযানে সিসায় মাদক মেশানোর বিষয়টি ধরা পড়েছে। এমনকি ল্যাবে পরীক্ষা করে সিসায় মাদক মেশানোর আলামত পাওয়া গেছে। সামপ্রতিক সময়ে পরীক্ষায় দেখা গেছে, সিসায় মাদকের উপাদান না পাওয়া গেলেও এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর মধ্যে উচ্চমাত্রার টক্সি, কার্বন মনো-অক্সাইড হেভি মেটালসহ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান থাকে। টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল হাসিসের নির্যাসের সঙ্গে রাসায়নিক মিশ্রণে সিসা তৈরি হয়। এতে নিকোটিনের পরিমাণও থাকে মাত্রাতিরিক্ত। তামাক বিশেষজ্ঞদের মতে, এক সেশনে সিসা টানলে ৫৪টি সিগারেটের সমান ক্ষতি হয়। এ ছাড়া সিসার ধোঁয়ায় প্রচুর পরিমাণে কার্বন মনোঅক্সাইড থাকে, যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাদের মতে- সিসা সিগারেটের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এ ছাড়া সিসায় ফলের নির্যাসের সঙ্গে অন্যান্য ক্ষতিকর মাদকদ্রব্যর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। অন্য মাদকে যে ক্যান্সার ছড়াতে পাঁচ বছর সময় লাগবে সেখানে নিয়মিত সিসায় আসক্ত হলে দুই বছরের মধ্যে শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে পারে।
