বিডিমেইলডেস্কঃ শত শোষণ, নিপীড়ন আরবৈষম্য থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্রমেই এগিয়েযাচ্ছে মৌলভীবাজারের ৯২ টি চা বাগানেরশ্রমিকরা। শিক্ষা ক্ষেত্রে চা শ্রমিকরা অনেক দূরএগিয়েছে। শিক্ষার দ্যূতি ছড়িয়ে চা শ্রমিকদেরঅনেকেই এখন জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে দেশেরবিভিন্ন সেক্টরে চাকুরিরত। তবে পর্যাপ্ত সরকারি ওবেসরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে শিক্ষার ক্ষেত্রেবৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে পারবে সকল ক্ষেত্রেবঞ্চিত চা শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। তবে এআশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না, অদূর ভবিষ্যতেএসব বাগানে চা শ্রমিক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। হুমকির মুখেপড়বে চা শিল্প। তাই বিকল্প পথটিও খুঁজে বের করতেহবে সংশ্লিষ্টদের-এমনটাই অভিমত বিশ্লেষকদের।
সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে শ্রীমঙ্গলের খেজুরিছড়া চাবাগানের চা শ্রমিকদের মহল¬ার টেপে খাবার পানিনিতে অপেক্ষা করতে দেখা যায় অসংখ্য নারী-শিশুকে। অ্যালুমিনিয়ামের এক কলসি খাবার পানিসংগ্রহ করতে তাদের অপেক্ষা করতে হয় টানা একঘণ্টা। উপজেলার রাজঘাট ইউনিয়নের খেজুরিছড়া চামহল্লায় খাবার পানির টানাপোড়েন লেগেই থাকে। এইবাগান ছাড়াও অন্যান্য চা বাগানে খাবার পানির তীব্রসংকট রয়েছে। জেলার বিভিন্ন বাগান ঘুরে এসব তথ্যপাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, জেলায়৯২টি চা বাগান রয়েছে। চা চাষের জমির পরিমাণ ৩২হাজার ৭০৮ হেক্টর। আর চা উৎপাদনের পরিমাণ ৩কোটি ৫৪ লাখ ৭৮ হাজার কেজি। ৯২টি চা বাগানেরঅধিকাংশ বাগানেই চা শ্রমিক পাড়ায় খাবার পানিরসংকট তীব্রতর বলে জানালেন বাংলাদেশ চা শ্রমিকট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী।তিনি জানান, গভীর নলকূপ থেকে যে পানিসরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায়অনেক কম। পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নারী ওশিশুদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ফলে চাবাগানের কাজে সময়মতো যেতে পারেন না। নিরাপদখাবার পানি সংকটের কারণে চা বাগানের নারী ওশিশুরা পেটের পীড়াসহ নানা অসুখে আক্রান্ত হয়েথাকে। একই অবস্থা বিরাজ করছে শ্রমিকদেরস্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও। তিনি আরও জানান, শিক্ষাক্ষেত্রে শূন্যের কোটা থেকে এখন অনেক দূরএগিয়েছে চা শ্রমিকরা। তবে দৃশ্যমান কোনোঅগ্রগতি উল্লেখযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার আরওআন্তরিক হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনসাধিত হবে। যদিও সরকার চা শ্রমিকদের উন্নয়নেমজুরি বৃদ্ধিকরণসহ একাধিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সম্প্রতি হাসপাতালের শিশু বিভাগে ভর্তি হয়েছেরাজনগর চা বাগানের শ্রমিক বিমল ও নীলিমার তিনবছরের ছেলে সিবাস। নীলিমা জানায়, রাজনগর চাবাগানের আশপাশে কোনো হাসপাতাল নেই। তাইছেলেকে নিয়ে সরাসরি সদর হাসপাতালে এসেছেন।তিনি জানান, স্বামী বিমল ও তিনি রোজ ৮৫ টাকাবেতনে রাজনগর চা বাগানে কাজ করেন। এ দিয়েসংসার চলে না। এর ওপর ছেলের চিকিৎসা ব্যয়তিনি কীভাবে মেটাবেন। শুধু রাজনগর চা বাগান নয়,মৌলভীবাজারের অন্যান্য চা বাগানে চিকিৎসা বলতেশুধু বাগানের ডিসপেনসারি। সরকারি চিকিৎসা সেবানেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা:সত্যকাম চক্রবর্তী জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে চাবাগানের শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবা বাগানের অধীনেহয়ে থাকে। সম্প্রতি সরকার বাগানগুলোতে সরকারিচিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেছে। প্রাথমিকচিকিৎসা সেবার মৌলভীবাজারে ৯২টি চা বাগানেসরকারের ৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এরমধ্যে ৩টি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থারয়েছে। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়েছে চা বাগানেরশিশুরা। যদিও অনেক বিদ্যালয় এখনও সরকারিকরণহয়নি। কয়েকটি চা বাগানে স্কুল খুলতে দেওয়া হয়না বলেও অভিযোগ করেন চা শ্রমিকদের বসতিএলাকা রামনগরের মণিপুরী গ্রামে মহিলা ও শিশুমন্ত্রণালয় এবং ইউনিসেফ’র সহযোগিতায় পরিচালিতব্র্যাক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা রোহেনা আক্তার।তিনি জানান, চা বাগানের শিশুদের স্কুলে যাওয়ারহার বেড়েছে। কিন্তু মা-বাবা চা বাগানে কাজ করায়তাদের ছোটো সন্তানকে শিশুদের কাছে রেখে যান।
ইউনিসেফ’র সিলেট বিভাগের উন্নয়নের জন্যযোগাযোগ কার্যক্রমের প্রধান কর্মকর্তা সাঈদ মিল্কীজানান, চা বাগানের শিশুদের শিক্ষার আলোয়আলোকিত করতে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিতকার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।
এ সম্পর্কে সমনবাগ চা বাগানের ব্যবস্থাপকমোহাম্মদ শাহজাহান ও মৌলভীবাজার চা বাগানেরব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম মামুন জানান, চাশ্রমিকদের আগের তুলনায় এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ওচিকিৎসা সেবা অনেক উন্নত হয়েছে। চা শ্রমিকপাড়ায় শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে।
চা বাগানের শ্রমিকদের জীবনমান বিষয়ে কয়েকবছরে ধরে গবেষণা করছেন জনউদ্ভিদবিদ্যা ওপ্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ।তিনি জানান, বাংলাদেশের সব চা বাগানই একইধরণের, তা ফিনলে-ডানকান-ইস্পাহানি-ই হোক আরসরকারি বাগান অথবা ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানইহোক, এসব বাগানে রয়েছে শ্রম শোষণ, মজুরিবৈষম্য, শিশুশ্রম, লিঙ্গীয় নিপীড়ন, মাত্রাতিরিক্তরাসায়নিক বিষের ব্যবহার, বহিরাগত বাণিজ্যিকমদের ব্যবসা, ঔপনিবেশিক মনস্তাত্ত্বিক শাসন,প্রত্যক্ষ দাসত্বপ্রথা, খাবার পানির অভাব এবংবাগানের শিশুদের জন্য শিক্ষার কোনো পর্যাপ্ত ব্যবস্থানা রাখা এবং সর্বোপরি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবানা থাকা। এমন অসংখ্য অন্যায়-অবিচার ছড়িয়েরয়েছে দেশের সব ক’টি চা বাগানে। কবে এদের মুক্তিমিলবে-এ প্রশ্ন তাই বাগানে কর্মরত হাজার হাজারশ্রমিকদের।