স্পোর্টস ডেস্কঃ
নিজেদের দেশের মাটিতে, উপচানো গ্যালারির সামনে বিদায় নেওয়ার সৌভাগ্য যে
হবে না, এ নিয়তি মিসবাহ-উল-হক মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর
বিদায়টা যেভাবে হলো, মিসবাহ নিজেই স্বীকার করেছেন, এর চেয়ে বেশি কিছু
চাওয়ার নেই।
৫৯
বছর ধরে চলা এক ধাঁধার উত্তর মিলিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। দিনের ৬ বল বাকি
থাকতে শেষ ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানকে আউট করে ডমিনিকা টেস্টটা জিতেছে ১০১
রানে। আর এই জয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পেল
পাকিস্তান। আগে পাকিস্তানের কোনো অধিনায়কই যা পারেননি, সেটাই করে দিলেন
মিসবাহ। দিনের শেষ ওভারের আগের ওভারের শেষ বলটাই ইতিহাসের পাতায় তুলে দিল
তাঁর নাম। ২-১-এ সিরিজ জিতল পাকিস্তান।
দুই
দলের প্রথম ইনিংস শেষ হতেই চতুর্থ দিনের প্রথম সেশনটাও খেয়ে ফেলা এই মন্থর
টেস্ট যে এমন নাটকের পসরা সাজিয়ে রেখেছিল, কে জানত! শেষ দিনের শেষ বিকেলটা
হয়ে গেল আরও নাটকীয়।
৩০৪
রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৫২ রান তুলতেই ৭ উইকেট হারানো ওয়েস্ট
ইন্ডিজ স্বপ্ন দেখেছিল টেস্টটা বাঁচিয়ে ফেলার। রোস্টন চেজ টেল এন্ডারদের
নিয়ে লড়লেন। তাঁকে দারুণ সঙ্গ দিচ্ছিলেন দেবেন্দ্র বিশু, আলজারি জোসেফ ও
শ্যানন গ্যাব্রিয়েলরা। নাহ্! এঁরা রান করেননি, সময় কাটিয়েছেন। বিশু ৪৫ বলে
খেললেন ৩ রান, জোসেফ ৩২ বলে ৫ আর গ্যাব্রিয়েল ২২ বলে ৪ রান। ওদিকে চেজ
অপরাজিত সেঞ্চুরি করে।
দিনের
একেবারে শেষ লগ্নে দলের শেষ ব্যাটসম্যান গ্যাব্রিয়েল ২১ বল পার করে দেওয়ার
পর আর একটি বল খেললেই ম্যাচটা চলে যেত শেষ ওভারে, আর সেটি পার করে দেওয়ার
জন্য অন্য প্রান্তে চেজ তো ছিলেনই। উইকেটে জমে থাকা এক ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট
ইন্ডিজ একেকটা বল পার করে দেয়, আর গ্যালারিতে সমুদ্রের নাচন ওঠে। আর মাত্র
সাতটা বল, পাকিস্তানকে কিছুতেই ট্রফিটা জিততে দেওয়া যাবে না—গ্যালারিতে
তখন এমনই অনুরণন।
ঠিক
তখনই গ্যাব্রিয়েল যেন নিজেকে ভিলেন বানাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। টেস্ট
ক্রিকেটের ইতিহাসে পরিস্থিতি অনুযায়ী সবচেয়ে বাজে শটটাই খেললেন! অথচ দুই বল
আগেই বেঁচে গিয়েছিলেন রিভিউ নিয়ে। আম্পায়ার ক্যাচ আউট ঘোষণা করলেও
রিপ্লেতে দেখা গেছে বল ব্যাটে লাগেনি। এমনভাবে জীবন পাওয়া গ্যাব্রিয়েল শেষ
বলটা না ঠেকিয়ে যেন ছক্কা হাঁকাতে চাইলেন। ইয়াসির শাহর অফ স্টাম্পের বাইরের
বলটি টেনে আনলেন নিজের স্টাম্পে। বোল্ড! অলআউট ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
এর
আগে চেজকে নিয়েও তো নাটক কম হয়নি। পুরো সিরিজেই দুর্দান্ত খেলা চেজ ‘বীর’
হতেই পারতেন। কিন্তু হয়ে গেলেন ট্র্যাজিক হিরো। ৩৬৬ মিনিট উইকেটে থেকে ২৩৯
বল খেলে ১০১ রানে অপরাজিত থাকলেন তিনি। আউট হতেই পারতেন। তিনবার ভাগ্য
ফিরিয়েছে তাঁকে। হাসান আলী দুবার ফিরতি ক্যাচ ফেলেছেন। ৯২ রানের মাথায়
মোহাম্মদ আব্বাসের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরতে শুরু করেছিলেন। টিভি
রিপ্লেতে দেখা গেল আব্বাস ‘ওভার স্টেপিং’ করেছেন। আবারও উইকেটে ফিরলেন
চেজ, আবারও ফিরল স্বাগতিকদের ম্যাচ বাঁচানোর আশা।
এভাবেই
যখনই পাকিস্তান জয়ের প্রান্তে পৌঁছে গেছে, তখনই এমন কিছু ঘটেছে, যেন
অলক্ষ্যে থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছিল। প্রায় ছয় দশক ধরে পাকিস্তানকে এই অদ্ভুত
ধাঁধায় ফেলে রাখা সেই ক্রিকেট নিয়তিই যেন চায় না, কিছুতেই পাকিস্তান ম্যাচ
জিতুক! সেই পাকিস্তানই শেষ পর্যন্ত জিতে গেল গ্যাব্রিয়েলের ক্ষণিকের
হতবুদ্ধি শটে। ভাষ্যকার ফাজির মোহাম্মদ তখন বলছেন, ‘এ তুমি কী করলে! এ
তুমি কেন করলে!’
পাকিস্তান তখন মাঠময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কাঁধে তুলে নিচ্ছে দুই বিদায়ী সতীর্থকে। আর অপরাজিত থেকে ফেরা চেজ তখন পরাজিত এক সৈনিক।
শেষ
দিনে পাকিস্তানের ‘হিরো’ ইয়াসির শাহ। ওই শেষ উইকেটটি নিয়েছেন বলেই নয়, ৩৭
ওভার বল করে ৯২ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছেন। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসের
সর্বোচ্চ রানটাও তাঁর ব্যাটে। যদিও ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা পেলেন চেজই।
হাসান
আলীও দারুণ বল করেছেন। ২০ ওভারে মাত্র ৩৩ রান দিয়ে তিনি তুলে নিয়েছেন ৩
উইকেট—শাই হোপ, জেসন হোল্ডার ও জোসেফের উইকেট তিনটি। চাপ তৈরিতে বড় ভূমিকা
রেখেছেন দুই পেসার মোহাম্মদ আমির ও মোহাম্মদ আব্বাস। ক্যারিবীয়দের প্রথম
ইনিংসের শেষ দিকে আব্বাসের ৫ উইকেটই তো তৈরি করে দিল পাকিস্তানের জয়ের
মঞ্চ।
ডমিনিকা
টেস্ট ম্যাচটা যে শেষ পর্যন্ত এমন নাটক উপহার দেবে, সেটি কে ভেবেছিল! অথচ
প্রথম তিনটা দিন এই টেস্টটাই তো উপহার দিয়েছিল রাজ্যের বিরক্তি! টেস্ট
ক্রিকেট বোধ হয় এমনই। রং বদলাতে পারে যেকোনো সময়। ক্রিকেট–রোমান্টিকরা বোধ
হয় এ কারণেই এই সংস্করণের ওপর থেকে কখনোই বিশ্বাস হারান না। সূত্র:
ক্রিকইনফো
