অনলাইন ডেস্কঃ মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটকে অধিক কার্যকর করতে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সুবিধা ছড়িয়ে দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আটটি বিভাগীয় শহরে আটটি আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র (আরসিসি) গড়ে তোলা। সেখানে ১০০ বেডের ইনডোর, বিকিরণ চিকিৎসার জন্য একটি টেলিথেরাপি ও একটি ব্রাকিথেরাপি মেশিন, ক্যান্সারের অপারেশনের ব্যবস্থা, ইনডোর ও ডে-কেয়ারে কেমোথেরাপির ব্যবস্থা থাকলেই চলবে। মেডিভয়েসের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথা বলেছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলিকে সমাজভিত্তিক রূপ দেয়া সম্ভব। এগুলি থেকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জেলা-উপজেলায় সনাক্তকরণ ক্যাম্প নিয়মিত আয়োজনের মাধ্যমে একেবারে শুরুতেই ক্যান্সার নির্ণয় হলে হাসপাতাল শয্যার ব্যবহার, আর্থিক ও শারিরীক কষ্ট কমবে। এতে কর্মঘন্টার অপচয় কম হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ঐ এলাকায় অবস্থিত সরকারী-বেসরকারী মেডিকেল কলেজ এবং আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ঊর্ধমূখী-নিম্নমূখী রেফারেল সিস্টেম গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজভিত্তিক আদর্শ সমন্বিত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলে দেশের ক্যান্সার পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি সম্ভব। ডা. রাসকিন বলেন, এরফলে- ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট অসহনীয় চাপমুক্ত হয়ে সারাদেশের জন্য বিশেষজ্ঞ তৈরি, মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালে কর্মরত প্যাথলজিস্ট, সার্জন, গাইনোকোলজিস্ট, নার্স ও সহায়ক জনবলের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করে আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে ইন্সটিটিউটে সকল বিভাগকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সমানভাবে বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। জাতীয প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সার্বিক ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিতে হবে। চিকিৎসার পাশাপাশি ক্যান্সার নিবন্ধন, স্ক্রিনিং, গবেষণা কাজে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা দিতে হবে। তিনি জানান, সরকার ইতোমধ্যে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং বা শনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে ৩৭৩টি ভায়া সেন্টার চালু করেছে। এটা একটা বড় অগ্রগতি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও সহজপদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। যার ফলে, প্রকল্পটি কাঙ্খিত সাড়া জাগাতে পারছে না। ডা. রাসকিন দুঃখ করে বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুমিত বিপুলসংখ্যক রোগীর চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটিতে সারা দেশের রোগী ভীড় জমাচ্ছেন। তাদেরকে অপারেশনের জন্য গড়ে একমাস, কেমোথেরাপির জন্য ২-৩ সপ্তাহ, বিকিরণ চিকিৎসার জন্য ৪ মাস পর্যন্ত অনেককে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য এসে রোগী হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ না পেলে স্বজনসহ অবর্নণীয় পরিস্থিতির শিকার হন। এই অবস্থায় অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে আরও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন। কেবল শয্যা সংখ্যা বা যন্ত্রপাতি বাড়িয়ে ক্রমবর্ধমান চিকিৎসাপ্রার্থীর চাপ সামলানো একটিমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, ১৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজে রেডিওথেরাপি বিভাগ চালু আছে। এর মধ্যে ৯টিতে বিকিরণ চিকিৎসার যন্ত্র আছে। কিন্তু কারিগরি সমস্যার কারণে সব কয়টি মেশিন একসাথে চালু থাকে খুব কম সময়ই। সহায়ক চিকিৎসক যেমন শল্যবিদ, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ থাকা সত্তেও আন্তঃবিভাগ সমন্বয় ও রোগীদের আস্থার অভাবে ক্যান্সার রোগীদের কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকা ও কর্মস্থলে অনুপস্থিতি সেবা প্রদানে বিঘ্নের কারণ। তাই সবাই ছুটছে ঢাকার ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে। বাংলাদেশের ক্যান্সার সচেতনতা আন্দোলনের এই অগ্রনায়ক বলেন, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। প্রাথমিক প্রতিরোধ, সূচনায় ক্যান্সার নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রশমন সেবা বা পেলিয়েটিভ চিকিৎসা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ক্যান্সারের জন্য বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো ও চিকিৎসা সরঞ্জামের পিছনে। ক্যান্সার নির্ণয় ও স্ক্রিনিং খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত। প্রাথমিক প্রতিরোধের প্রধান উপাদান ক্যান্সারের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ও টিকা সহ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। এ ক্ষেত্রটি সবচেয়ে অবহেলিত আছে। সরকারের কিছু উদ্যোগ আছে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে তা দৃশ্যমান প্রভাব ফেলতে পারছে না। বেসরকারি সংগঠনগুলি মূলত সচেতনতা কার্যক্রমকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ডা. রাসকিন বলেন, বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সার ইউনিট চালু হয়েছে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসার খরচ অত্যাধিক বা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা অতি কেন্দ্রীভূত। একটিমাত্র বেসরকারি ক্যান্সার ইউনিট রয়েছে ঢাকার বাইরে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সার নির্ণয়ের এক বছরের মধ্যে শতকরা প্রায় পচাত্তর ভাগ রোগী হয় মারা যাচ্ছে, না হলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। নিম্ন-আয়ের এবং অগ্রসর ক্যান্সার রোগীরা বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। ক্যান্সার ইনস্টিটিউট কেন্দ্রিক সরকারী চিকিৎসা, কিংবা কয়েকটি ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক হাসপাতাল এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নয়। এরজন্য চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
ঢাকার বাইরে ৮টি আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র স্থাপন জরুরি
প্রকাশে »বিডি মেইল ডেস্ক
- প্রকাশকাল »
0
