উপরে স্বস্তি নিচে ভোগান্তি

উপরে স্বস্তি নিচে ভোগান্তি
শুভ্র দেবঃ রাজধানীর যানজট নিরসনে তৈরি ফ্লাইওভারে কিছুটা স্বস্তি মিললেও এর নিচে বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আর উদাসীনতায় নানামুখী ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বেহাল সড়ক আর ধুলো-ময়লার কারণে পথচারীকে যানবাহনে চলতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। একই সঙ্গে ধুলো-ময়লার কারণে আশপাশের এলাকার আবাসিক ভবন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ছে এর নেতিবাচক  প্রভাব। রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভার এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। যাত্রাবাড়ী মোড়ে ফ্লাইওভারের নিচে ময়লার স্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে ফল বিক্রি করছিলেন ৬০ বছর বয়সী ফজলুর রহমান। ১৪ বছর ধরে তিনি এখানে ফল বিক্রি করেন। তিনি বলেন, আগে ভালোই বিক্রি হতো। কিন্তু এখন বিক্রি অনেক কমে গেছে। আগে আশপাশের সব জায়গার গাড়িগুলো যাত্রাবাড়ী হয়ে গন্তব্য যেতো। কিন্তু এখন ফ্লাইওভার হওয়াতে বেশিরভাগ গাড়ি ওপর দিয়ে চলে যায়। নিচে গাড়ির সংখ্যা কমলেও জঞ্জাল কমেনি। ধুলো-ময়লা পরিষ্কারের যেন কেউ নেই। যাত্রাবাড়ি ঘুরে দেখা যায়, ফ্লাইওভারের নিচের ও আশপাশের রাস্তাগুলো খানা-খন্দে ভরা। যাত্রাবাড়ী থেকে কাজলা- মৃধাবাড়ী, ডেমরা, পোস্তগোলা, শনির আখড়া, রায়েরবাজার, পোস্তগোলা, ধোলাইপাড়ের রাস্তার অবস্থা খুবই করুণ। আবার ধুলাবালির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে এখানকার পথচারীরা। রাস্তার ওপর ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এমনকি রাস্তার ওপর সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনগুলো রাখা হয়েছে। দুর্গন্ধের কারণে পথচারীরা চলাচল করতে পারছে না। আব্দুর রহিম নামের এক পথচারী বলেন, ঢাকার সবচেয়ে খারাপ জায়গা এখন যাত্রাবাড়ী। অন্যদিকে ফ্লাইওভারের আশপাশের বাড়ির মালিকরাও বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না। সারা বছর ধুলাবালি-কাদা অতিরিক্ত শব্দদূষণ আর বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণে এখন অনেক ভাড়াটিয়া জুরাইন, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়ার দিকে বাসা নিচ্ছেন। আনোয়ার হোসেন নামের এক বাড়ির মালিক বলেন, অনেকেই যাত্রাবাড়ী থেকে বাসা পরিবর্তন করে এখন ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় বাসা নিচ্ছেন। যাতে সহজেই ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে গন্তব্য পৌঁছাতে পারেন। তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে আমার কয়েকটা ফ্ল্যাট ভাড়া হচ্ছে না। শাওন হাসান নামের এক চাকরিজীবী বলেন, আমি আগে এদিকেই থাকতাম। কিন্তু এখন জায়গাটা অনেক নোংরা, থাকার মতো কোনো পরিবেশই নেই। তাই আমি গত ছয় মাস ধরে শনির আখড়ায় থাকি। সেখানে অনেক কম দামে ভালো বাসা পাওয়া যায়। আমার অফিসও গুলিস্তান। বাসা থেকে বের হলেই বাস পাওয়া যায়। ফ্লাইওভার দিয়ে খুব সহজেই আমি গুলিস্তান চলে যাই। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করেন জুনায়েদ এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইদুল ইসলাম। তিনি অনেকটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন, চার বছর আমার ব্যবসা বন্ধ ছিল। প্রথমে ফ্লাইওভার নির্মাণ হলো; পরে আবার ইউলোপের কাজের জন্য রাস্তা বন্ধ ছিল। এখন তিন মাস ধরে আবার ব্যবসা শুরু করেছি। তবে আমার পুরনো কাস্টমাররা এখন আর নেই। বেচা-বিক্রিও তেমন ভালো না। ফ্লাইওভারের কাজের জন্য আমরা অনেক দিন ব্যবসা ছাড়া কাটিয়েছি। সব মিলিয়ে এখন আমার অবস্থা খুবই খারাপ। নবনির্মিত মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচের ব্যবসায়ীদের। এখানকার ব্যবসায়ীরাও আগের মতো ব্যবসা করতে পারছেন না। অনেক ব্যবসায়ী বলেন যখন থেকে ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হয়েছে তখন থেকে আমাদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। এখনও অনেক কাজ চলছে। জানি না কবে কাজ শেষ হবে। আমরা অনেকেই ব্যবসার পুঁজি দিয়ে দোকানভাড়া, কর্মচারীর বেতন, আমাদের খরচ বহন করছি। তবে সবচেয়ে কঠিন জীবনযাপন করছেন নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নিচের ব্যববসায়ীরা। একদিকে চলছে মাটির নিচে বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি আবার অন্যদিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণসামগ্রী  রাস্তার ওপর ফেলে রাখার কারণে প্রধান সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে গাড়ি চলাচল তো দূরের কথা মানুষ চলাচল করার জায়গা নেই। রাজারবাগ-মৌচাক-মগবাজার-শান্তিনগর-মালিবাগ বাজারে ফ্লাইওভার নির্মাণ করার কারণে আশপাশের অনেক বড় মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এখন ক্রেতা শূন্য সময় পার করছেন। ফরচুন মার্কেট, মৌচাক মার্কেট, আনারকলি মার্কেট, সেন্টার পয়েন্ট, হোসাফ মার্কেট, টুইন টাওয়ার, কর্ণফুলী মার্কেটসহ ছোট-বড় আরো কিছু মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ীরা বলেন, রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে গাড়ি চলাচল করতে পারে না। রাস্তাগুলো নোংরা কাদায় ভরপুর। মানুষ হাঁটাচলা করতে পারে না। রাস্তা সরু হওয়ার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। তাই এখন আমাদের ক্রেতারা অন্যদিকে চলে যায়। মালিবাগ রেলগেটের পাশের এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, গত কয়েক মাস ধরে দোকান খুলে রাখি। কিন্তু কোনো বিক্রি নেই। দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছি না। হোটেলের পাশের আরো অনেক ব্যবসায়ী তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, একের পর খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। তবে রাস্তা বন্ধ করায় এবং গাড়ি ও মানুষ চলাচল করতে না পারায় আমাদের ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। ফরচুন মার্কেটের সামনে চা বিক্রেতা আলী হোসেন বলেন, আমি এখানে পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা করি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরেই রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। রাস্তার মধ্যে বড় বড় গর্ত হয়ে পানি জমে আছে। এখন রাস্তাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাই এখন আমার ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। গরিব মানুষ আমি; এই দোকান থেকে যা আয় হতো তা দিয়েই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কষ্ট করে চলতাম। এখন সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে। বাসাভাড়া দিতে পারছি না। ঘরের জন্য ঠিকমতো বাজার করতে পারছি না। মালিবাগ মোড়ের ফুটপাতে বসে বাচ্চাদের কাপড় বিক্রি করতেন আলম মিয়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরচুন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখানে ব্যবসা করছি। কিন্তু আমাদের ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে। ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা, মানুষ রাস্তা দিয়ে এখন চলাচল করা বন্ধ করে দিয়েছে। আশপাশের স্থানীয় কিছু মানুষ ছাড়া তেমন কোনো ক্রেতা নেই। কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আবার যে সব রাস্তা খোলা আছে সেগুলো নোংরা, কাদা, পানি, নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার কারণে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। লাইন ধরে গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষ পায়ে হেঁটেও চলাচল করতে পারে না। রাস্তার এ দুরবস্থার জন্য তারা দায়ী করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি সংস্থাকে। এ ব্যাপারে মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, মগবাজার ফ্লাইওভারের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা হাতেম আলী বলেন, আমরা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছি না। আমাদের জন্য রাস্তাও বন্ধ হচ্ছে না। এগুলো সিটি করপোররেশন আর ডিপিডিসির কাজ। রাস্তার ওপর আমাদের যে মালামাল রয়েছে সেগুলো আমরা এমনি এমনি রাখিনি। সবটাই ফ্লাইওভারের কাজের জন্য রাখা হয়েছে। আগামী জুন মাস পর্যন্ত সড়কের পুরো সমস্যা মিটবে না বলে জানান তিনি।

Post a Comment

Previous Post Next Post