ফুটবল বিশ্বকাপের নান্দনিক ৮ স্টেডিয়াম

 



স্পোর্টস ডেস্কঃ দরজায় কড়া নাড়ছে ফিফা বিশ্বকাপ। আবর দুনিয়ায় এটি প্রথম বিশ্বকাপ। কাতারের রাজধানী দোহাতেই হবে বিশ্বকাপের সমস্ত খেলা। দোহাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ৮টি স্টেডিয়ামে হবে মোট ৬৪টি ম্যাচ। কোন মাঠে খেলা হচ্ছে, সেখানে দর্শক উপস্থিতি কেমন হতে পারে, সুযোগ-সুবিধা কেমন সেসব জানতে সাধারণ দর্শক সব সময় উৎসুক হয়ে থাকেন। এমনকি স্টেডিয়ামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়েও দর্শকদের আগ্রহ থাকে তুঙ্গে।

বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে ৮টি স্টেডিয়ামে খেলা হবে। স্টেডিয়ামগুলোর রঙিন আলোর নিচেই ভাগ্য নির্ধারিত হবে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর। যেখানে কেউ উচ্ছ্বাসে ভাসবে, অন্য কেউ পুড়বে হতাশায়। বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ কাতারে বেশির ভাগ স্টেডিয়াম নতুনভাবে নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বকাপের সেসব স্টেডিয়াম সম্পর্কে একনজরে জেনে নেওয়া যাক।

লুসাইল স্টেডিয়াম, লুসাইল (ধারনক্ষমতা ৮০ হাজার)

কাতার বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি চোখ থাকবে লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের দিকে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর এই স্টেডিয়ামে হবে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় এই স্টেডিয়াম। দোহা থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে দুই লাখ জনসংখ্যার পরিকল্পিত একটি শহর লুসাইল। গ্রুপ পর্বে আলাদা ম্যাচে এই মাঠে খেলতে নামবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের মতো ফেবারিটরা। ২২ নভেম্বর ২০২১ সালে মাঠটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে। বিশ্বকাপের পর লুসাইল স্টেডিয়ামটি স্কুল, দোকান, ক্যাফে, খেলাধুলার সুবিধা এবং ক্লিনিকসহ একটি কমিউনিটিতে রূপান্তরিত হবে। তখন স্টেডিয়ামের ৮০ হাজার আসনের বেশিরভাগই সরিয়ে নেওয়া হবে এবং ক্রীড়া প্রকল্পগুলিতে দান করা হবে।

বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, একটি করে কোয়ার্টার-ফাইনাল ও সেমিফাইনাল এবং ফাইনালসহ এই স্টেডিয়ামে ম্যাচ হবে ১০টি।

আল-বায়াত স্টেডিয়াম, আল-খোর (ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার)

লুসাইল স্টেডিয়ামের পর সবচেয়ে বেশি চোখ থাকবে আল-বায়াত স্টেডিয়ামের দিকে। আল খোর শহর কাতারের উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। কাতারের রাজধানী দোহা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরে। আরব কাপে বাহরাইন-কাতার ম্যাচ দিয়ে যাত্রা শুরু করে এই স্টেডিয়াম। এটিকে কাতারের প্রধান শহরগুলির একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে একটি বিশালাকার তাঁবুর আকৃতির কাঠামো রয়েছে। এটি বাইত আল শা’আর-এর নামে নামকরণ করা হয়েছে, যা মূলত কাতার ও উপসাগরীয় অঞ্চলের যাযাবর মানুষদের ঐতিহাসিকভাবে ব্যবহৃত তাঁবু। স্টেডিয়ামটির নকশা কাতারের অতীত এবং বর্তমান ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে। বিশ্বকাপের পর স্টেডিয়ামটির ছাদ সড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে। আল-খোর থেকে রাজধানী দোহায় দ্রুত পৌঁছানোর জন্য মেট্রো রেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আল-রাইয়ান (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)

কাতার ফাউন্ডেশনের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম দোহার পশ্চিমাঞ্চলে আল-রাইয়ান শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত। রাজধানী দোহা থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হীরার আকৃতির এই স্টেডিয়াম। এখানে যেতেও মেট্রো ব্যবহার করতে হবে। এই স্টেডিয়ামে ২০ শতাংশ সবুজ কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব স্টেডিয়ামগুলোর একটি। ২০০৩ সালে এই স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হলেও বিশ্বকাপ সামনে রেখে ফের সংস্কার করা হয়েছে স্টেডিয়ামটি। বিশ্বকাপের পর এর ধারনক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে।

বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো ও একটি কোয়ার্টার-ফাইনালসহ এই মাঠে ম্যাচ হবে মোট ৮টি।

আহমাদ বিন আলি স্টেডিয়াম, আল-রাইয়ান (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)

কাতারের ঘরোয়া ফুটবলের অন্যতম সফল ক্লাব আল-রাইয়ানের হোম ভেন্যু এই আহমাদ বিন আলি স্টেডিয়াম। পুরনো ভেন্যু ঠিক পাশেই নতুন করে বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এই স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করা হয়েছে। রাজধানী দোহা থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এডুকেশন সিটির কাছেই এই ভেন্যুর জন্য একটি মেট্রো স্টেশন আছে। এখানে আসলে সমর্থকরা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির আবহ দেখতে পাবে। এই স্টেডিয়ামটি দেশটির সবচেয়ে বড় শপিং সেন্টারের পাশে অবস্থিত। এই স্টেডিয়ামটিরও ধারনক্ষমতা বিশ্বকাপের পর অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।

খালিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, দোহা (ধারণক্ষমতা ৪৫ হাজার ৫০০)

১৯৭৬ সালে নির্মিত এই স্টেডিয়ামটি কাতার বিশ্বকাপের স্বত্ব পাবার সময় একমাত্র ফুটবল ভেুন্য হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও তারপর এর অনেক কিছুই সংষ্কার করা হয়েছে। স্টেডিয়ামটি দোহার পশ্চিমে শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২০১১ এশিয়ান কাপ ফাইনাল, লিভারপুল ও ফ্ল্যামেঙ্গোর মধ্যকার ২০১৯ ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনাল এই স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ২১ নভেম্বর এই মাঠেই ইরানের বিপক্ষে ইংল্যান্ড তাদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করবে।

আল-থুমামা স্টেডিয়াম, দোহা (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)

দোহার জমকালো স্কাইলাইন থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই স্টেডিয়ামের কাছে হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আল থুমামা স্টেডিয়ামটি আরব বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ‘গাহফিয়া’-এর আদলে তৈরি করা। ‘গাহফিয়া’ হলো এক ধরনের বোনা টুপি, যা আরব বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই এলাকার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রতীকের জন্য স্টেডিয়ামটি একটি বার্তা। বিশ্বকাপের পর ব্যয় সংকোচনে এর ধারণক্ষমতা ২০ হাজারে নামিয়ে আনা হবে।

বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব, একটি করে শেষ ষোলোর ও কোয়ার্টার-ফাইনালসহ এই স্টেডিয়ামে ম্যাচ হবে মোট ৮টি।

স্টেডিয়াম ৯৭৪, দোহা (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)

৯৭৪ নম্বরটি কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়াল কোড। হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। একইসাথে স্টেডিয়াম নির্মানে যে কন্টেইনার ব্যবহার করা হয়েছে তার সংখ্যাও এর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব হয়েছে। বিশ্বকাপের পর এই স্টেডিয়ামটি পুরোপুরি ভেঙ্গে ফেলা হবে। নির্মাণে যে উপকরণগুলি ব্যবহার করা হয়েছে তা পুনরায় ব্যবহার করা হবে। ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটিই প্রথম সম্পূর্ণরূপে অপসারণযোগ্য ভেন্যু।

বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব থেকে শেষ ষোলো পর্যন্ত ৭টি ম্যাচ হবে এই মাঠে।

আল-জানুব স্টেডিয়াম, আল-ওয়ারকাহ (ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার)

দোহার দক্ষিনাঞ্চলীয় শহর আল-ওয়ারকাহতে এই স্টেডিয়ামটি অবস্থিত। রাজধানী দোহা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। এটিকে বর্তমানে কাতারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কাতারের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ নৌকার আদলে এই স্টেডিয়ামটি নির্মান করা হয়েছে। এই ধরনের নৌকার সাহায্যে সমুদ্রে মাছ ধরা ও মুক্তা আহরন করা হয়। এই স্টেডিয়ামটি একটি বিস্তৃত ক্রীড়া কমপ্লেক্সের অংশ। যেখানে সাইক্লিং ও হর্স ট্রেইল এর ব্যবস্থা এবং দোকান, রেস্তোরাঁ ও ক্রীড়া ক্লাব রয়েছে। বিশ্বকাপের পর স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা কমিয়ে ২০ হাজার আসন করা হবে।

বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব ও শেষ ষোলো মিলিয়ে স্টেডিয়ামটিতে ম্যাচ হবে মোট ৭টি।

অংশগ্রহণকারী দল কাতারের নিয়ম, প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি করা আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক মারা গেছেন বলে দাবি তাদের। এছাড়া সমকামীতা, মদ নিষিদ্ধ করায়ও চটেছেন সবাই। বিশেষত ইউরোপ থেকেই প্রতিবাদ আসছে বেশি। সবমিলিয়ে ফিফা ও কাতার প্রবলভাবে সমালোচিত, এই আবহেই বাঁশি বাজতে চলেছে ফুটবল বিশ্বকাপের।

উল্লেখ্য, রাত পোহালেই বিশ্বকাপের ২২তম আসর। অপেক্ষা শুধু বাঁশি বাজার। ২০ নভেম্বর বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পর্দা উঠবে কাতার বিশ্বকাপের। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে আয়োজক দেশ কাতার এবং ইকুয়েডর। আগামী ১৮ ডিসেম্বর ফাইনালের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে ফিফা বিশ্বকাপের।

Post a Comment

Previous Post Next Post