কিশোরী মিনা পাল যেভাবে ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী



নিউজ ডেস্কঃ ১৯৬৪ সাল, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত তার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘সুতরাং’ ছবির জন্য চট্টগ্রাম থেকে আনলেন এক কিশোরীকে। তার নাম মিনা পাল।

সুতরাং ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে মিনা পালের ফিল্মি নাম হয়ে গেল কবরী। সুতরাং মুক্তি পেলে এ ছবি এবং ছবির নায়িকা হিসেবে কবরী দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হন।

তারপর জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় কবরীর শুধুই দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলা। একদিকে দক্ষ অভিনয় অন্যদিকে মনকাড়া হাসি দিয়ে সহজেই তিনি দর্শকমন হরণ করেন। তাই দর্শক তাকে ‘মিষ্টি মেয়ে কবরী’ আখ্যা দিতে ভোলেননি।

প্রথম ছবিই কিশোরী মিনা পালকে রাতারাতি অভিনেত্রী কবরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বাংলা ছবি হিসেবে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সুতরাং’ ব্যাপক সম্মান পায়। মানে ‘সুতরাং’ দিয়েই বাংলাদেশি ছবির আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তি শুরু।

উর্দু ছবির ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে আস্থাভাজন হয়ে উঠেন কবরী। জনপ্রিয় সিনেমা সাত ভাই চম্পা, অরুন বরুন কিরণমালা, নীল আকাশের নীচে, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, আবির্ভাব, দর্পচূর্ণ, দ্বীপ নিভে নাই, বিনিময়, আপন পর, কত যে মিনতি, ময়নামতি দিয়ে স্বাধীনতা পূর্ব বাংলা চলচ্চিত্রে হয়ে উঠেন সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা। খ্যাতনামা পরিচালক জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘বাহানা’-তেও নায়িকা ছিলেন কবরী।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে কবরী নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন,  তখন আমার বয়স মাত্র ১৩ বছর। ক্লাস সিক্সে পড়ি। সুভাষ দত্ত একটা কিশোরীর ভূমিকার জন্য খুঁজে আমাকে পেয়ে যান। সাংস্কৃতিক পরিবারে মানুষ হয়েছি। মা পুঁথি পড়তেন, ভাইবোনেরা নাচতেন-গাইতেন, ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। আমি নাচ করতাম। তবে আগে অভিনয় করিনি। যখন অফার পেলাম, তখন বাবা খুবই উৎসাহিত হলেন। মা দিতে চাননি। তিনি বললেন, ওর পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে। পরিবার একটু রক্ষণশীল তো ছিলই। আমার মায়ের ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনেকদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই তার খুব শখ ছিল মেয়েকে পড়াবেন। আমি সুভাষ দত্ত, ফজলে লোহানী, খান আতা, জহির রায়হান থেকে অভিনয় শিখেছি। এখন তো সেরকম শিক্ষকও নেই।

বলা হয়, নায়করাজ রাজ্জাক চলচ্চিত্রের নীল আকাশের নীচে সর্দপে বিচরণ করতে পেরেছেন কবরীর মত নায়িকা পেয়েছেন বলে, মিঞা ভাই খ্যাত ফারুক চলচ্চিত্রের নীল দরিয়ায় নাও চালিয়ে সফল হয়েছিলেন কবরীকে পাশে পেয়েছিলেন বলে। বুলবুল আহমেদের ক্যারিয়ারেও সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা কবরী। চিত্রনায়ক রিয়াজের কাছে তিনি চিরসবুজ নায়িকা। উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমার নায়িকা হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন কবরী। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। সেখান থেকে পাড়ি জমান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। তখনকার স্মৃতি স্মরণ করে একবার কবরী বলেছিলেন, ‘সেখানকার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অবস্থার কথা তুলে ধরেছিলাম। কীভাবে আমি মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে পালিয়ে সেখানে পৌঁছেছি, সে কথা বলেছিলাম। সেখানে গিয়ে তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশকে সাহায্যের আবেদন করি।’

কবরী শেষ জীবনে ছিলেন, চলচ্চিত্র পরিচালক ও রাজনীতিবিদ। তিনি বিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের নায়িকা ছিলেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন অভিনেত্রী কবরী। জন্মস্থান বাঁশখালী হলেও শৈশব ও কৈশোর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীতে। তার আসল নাম মিনা পাল। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব কবরীর।

Post a Comment

Previous Post Next Post