বীরমুক্তিযোদ্ধা আত্তর আলীর ১৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

নিউজ ডেস্কঃ বৃহত্তর সিলেটের কৃতি সন্তান, পাকিস্তানি হায়েনাদের কালো পতাকা প্রদর্শন করে কারা বরণকারী তুখোড় ছাত্রনেতা, সমাজসেবক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বংগবীর এম এ জি ওসমানী স্মৃতি সম্মাননা  পুরষ্কার, জালালাবাদ সম্মাননা পুরষ্কার (মরনোত্তর) প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলী চৌধুরী আত্তরের আজ ১৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী। 
২০০২ সালে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক বছর বার্ধ্যক্যের সাথে যুদ্ধ করে ২০০৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কুলাউড়ার কাদিপুরের হোসেনপুর গ্রামে পারিবারিক কবর স্থানে এই বীরযোদ্ধাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এই উপলক্ষে বীরমুক্তিযোদ্ধা আত্তর আলী স্মৃতি সংসদ এর আয়োজনে মনসুর মোহাম্মদিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় দোয়া ও মিলাদ, মরহুমের ঢাকাস্থ বাসভবনে কোরআন খতম, দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে।
সবাইকে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ ভাবে দোয়ার দরখাস্ত করেছেন বীরমুক্তিযোদ্ধা আত্তর আলী স্মৃতি সংসদ এর অন্যতম সদস্য হাসানুর রহমান রুমেল ও মরহুমের পরিবার।


এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প; বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলী 
 
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প; বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলী

১৯৭১। মাতৃভূমির মুক্তির স্বার্থে বাংলা অন্যান্য সব দামাল ছেলেদের মতই ২৬ বছরের টগবগে যুবক আক্তার আলী চৌধুরী আত্তরও ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অনেকটাই নিভৃতচারী ছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ শেষ হলেও সোনার বাংলা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। দেশের নিপীড়িত ও নিগৃহিত মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। দেশপ্রেমী এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার কাদিপুর ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর বাবার নাম ইদ্রিস আলী ও মাতার নাম লতিফা বিবি, চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট ।

আত্তর আলী উচাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশুনা শেষ করেন তিনি। ওই সময় ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। ৬৬’র দিকে তৎকালীন মন্ত্রী দেওয়ান বাছিত নিজ এলাকায় সফরে আসলে ওইসময় পাক সরকারের দুঃশাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি এবং তাঁর সহযোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর আতিক কালো পতাকা তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এর দায়ে পাক পুলিশ বাহিনী তাকে এবং তার বন্ধু ওমর আতিককে গ্রেফতার করে মৌলভীবাজার জেলে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁরা বেশ কয়েকদিন জেল খেটে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। এভাবেই তৎকালীন সরকারের দুঃশাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে জুলাই মাসের দিকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ধর্মনগর শহরের ভাগপুর স্কুল ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪নম্বর সেক্টরের কমান্ডার সি আর দত্ত’র অধীনে কৈলাশহর হয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে শমসেরনগর, পতনউষারসহ কয়েকটি স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। এসব যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের ধুসরদের পরাজিত করে এসকল এলাকা পাকবাহিনী মুক্ত করেন। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে মৌলভীবাজার সরকারি স্কুলে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন তিনিসহ তাঁর সহযোদ্ধারা। সেখান থেকে পাক বাহিনীকে হটিয়ে ওই স্কুলটি মুক্তিযোদ্ধারা দখল নেন এবং সেখানে তাদের ক্যাম্প গড়ে তুলেন। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ওই ক্যাম্পে পাক বাহিনীর যুদ্ধে ব্যবহৃত ল্যান্ড মাইন ও মর্টার সেল বিষ্ফোরণ ঘটে । এতে সেখানে অবস্থানকারী বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। ভাগ্যক্রমে ঘটনার সময় আত্তর আলী ও তাঁর কিছু সহযোগী সেখানে অবস্থান না করায় ওই সময় বেঁচে যান। 
 
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প; বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলী
 
কুলাউড়া থেকে যে কয়জন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পেতে পারতেন, তাদের মাঝে তিনি ছিলেন অন্যতম। চুন্নু নওয়াব, রাজা সাহেব, আলাউদ্দিন চৌধুরী এ সব ব্যক্তিবর্গের সাথে ছিলো প্রতিদিনের চলাফেরা। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসাদুর রহমান, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক, বীর মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজির উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কুলাউড়া উপজেলা কমান্ডার আজহার আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক চেয়ারম্যান মুকিমুদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর আতিক, আলাউদ্দিন চৌধুরীদের সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন।
 
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প; বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলী
 
পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। মৃত্যুর আগে তিনি আলহাজ্ব কমরউদ্দিন ওয়াকফ এস্টেটের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০০২ সালে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক বছর বার্ধ্যক্যের সাথে যুদ্ধ করে ২০০৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কুলাউড়ার কাদিপুরের হোসেনপুর গ্রামে পারিবারিক কবর স্থানে এই বীরযোদ্ধাকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।
 
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প; বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলী
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর পুরষ্কার গ্রহন করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলীর সুযোগ্য উত্তরসুরী আনিসুর রহমান চৌধুরী লিটু
এলাকার অসহায় লোকজনের জন্য তাঁর সাহায্যের হাত ছিলো প্রসারিত। অনেক বেকারদের কর্মসংস্থানে রয়েছে তাঁর অবদান। এমন অনেক ব্যক্তি রেলওয়েসহ বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত আছেন। তাদের সাথে আলাপকালে তাঁরা জানান, আত্তর আলী ছিলেন পরপোকারী মানুষ। তাঁর সহযোগীতা না পেলে হয়তো আজ তারা এই অবস্থানে থাকতেন না। যুদ্ধ পরবর্তীকালে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু পল্টনে তাকে দোতলা একটি বাড়ি উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি না নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু ফেনী পুলিশ কোয়ার্টার পরিদর্শনে গেলে, সেই কোয়ার্টারে অবস্থান করছিলেন আত্তর আলীর মেজ ভাই (পুলিশ) আজমল আলীর স্ত্রী। তখন বঙ্গবন্ধুর সাথেই গাড়ী থেকে বের হয়ে এসেছিলেন হালকা পাতলা গড়নের আত্তর আলী। যা দেখে মরহুমের ভাবী অবাক হয়ে হয়েছিলেন। সিলেটের গৌরব মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, মরহুম সামাদ আজাদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদের সাথেও ছিলো খুবই ভালো সম্প্রীতি। এলাকার মানুষ তার হাসি মুখ ছাড়া কখনওই গোমড়া মুখ দেখেন নি। ঢাকাস্থ রামপুরার নীজ বাসভবনের এলাকাতেও সকলের প্রিয় পাত্র ছিলেন তিনি। তাঁর অফিস ফকিরাপুলের আশে পাশের সবাই ছিলেন তাঁর ভক্ত।
 
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প; বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলী
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর পুরষ্কার গ্রহন করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তার আলীর সুযোগ্য উত্তরসুরী আনিসুর রহমান চৌধুরী লিটু

Post a Comment

Previous Post Next Post