ক্ষোভের আগুনে ফুঁসছেন জাপার নেতাকর্মীরা


অনলাইন ডেস্কঃ জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের নির্বাচনী মনোনয়ন বাণিজ্য ছাড়াও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন দলটির বঞ্চিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

এ অভিযোগে তারা দল থেকে অবিলম্বে তাকে বহিষ্কারের দাবিও তুলেছেন। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের অভিযোগ- এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার জাতীয় পার্টির মহাসচিবের পদ ব্যবহার করে শুধু নিজের স্বার্থ দেখেছেন, নিজের আখের গুছিয়েছেন। জাতীয় পার্টির রাজনীতিকে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর এবার জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখেও বেপরোয়া বাণিজ্যে মেতে ওঠেন তিনি।

নিজের এবং স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্নার আসন নিশ্চিত করতে গিয়ে দলের স্বার্থ, মাঠপর্যায়ের নিবেদিত জনপ্রিয় নেতাকর্মীদের ন্যায্য স্বার্থ এবং তাদের অসীম ত্যাগ-তিতিক্ষাকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিয়েছেন। দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন, দলীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে নিজের সুবিধা হাসিল করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। বিপরীতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় পার্টি। সোমবার দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় পার্টি। এর অংশ হিসেবে সোমবার বেলা ৩টায় দলটির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার কথা জানান জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। সে অনুযায়ী পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনেরও আহ্বান করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে মহাসচিবের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের খবর জোরালো হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বনানী কার্যালয়ে ভিড় করেন। এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করে তার কাছে জানতে চান- কেন এমনটা হল?

জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতারা কেন মনোনয়ন পাওয়া থেকে বাদ পড়লেন? নেতাকর্মীদের এ রকম ক্ষোভ প্রকাশ ও মারমুখী আচরণ দেখে তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সংবাদ সম্মেলন করে উঠে পড়েন।

সাংবাদিকদের তেমন কোনো প্রশ্ন নিতে চাননি। এ সময় তিনি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা দেয়া থেকে পিছু হটেন। জানান, জাতীয় পার্টি ২০০ আসনে প্রার্থী দেবে। তার এ ঘোষণায় নেতাকর্মীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
একপর্যায়ে তারা মহসচিবকে বনানী কার্যালয়েই প্রায় দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের অনুগতরা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে গুলশানের বাসায় নিয়ে যান।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে প্রত্যাশিত আসনে ছাড় দেয়ার কথা থাকলেও মূলত মনোনয়ন বাণিজ্যের জন্য অনেক জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের নাম বাদ দেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। জোটগত নির্বাচনে ন্যূনতম ৫০টি আসন দাবি ছিল জাতীয় পার্টির। কিন্তু শুরু থেকেই রুহুল আমিন হাওলাদারের রহস্যময় ভূমিকার কারণে জাতীয় পার্টির প্রথম সারির বেশ ক’জন সংসদ সদস্য মহাজোটের মনোনয়নপ্রত্যাশী তালিকা থেকে বাদ পড়েন।

অভিযোগ উঠেছে, একটি বিশেষ মহলের কাছ থেকে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এসব আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিশ্চিত করেননি মহাসচিব। যেভাবে যুক্তিপূর্ণ শক্ত অবস্থান নিয়ে দরকষাকষি করা প্রয়োজন ছিল, তা তিনি করেননি। অভিযোগ আছে, দলের মনোনয়নে হবিগঞ্জ-১ আসনে জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল মুনিম চৌধুরী বাবুর নাম রোববার পর্যন্ত থাকলেও বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে শেষ মুহূর্তে তার নাম কেটে দিয়ে এ আসনে আতিকুর রহমান আতিককে অন্তর্ভুক্ত করেন রুহুল আমিন হাওলাদার।

সূত্র জানায়, মনোনয়ন পাননি এমন অনেক নেতার কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব। প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, কাজী মামুনুর রশীদ, মোস্তফা আল মাহমুদ, আলাউদ্দীন মৃধা, ছাত্রসমাজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম রিপনসহ অর্ধ শতাধিক নেতার কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন মনোনয়ন নিশ্চিত করা হবে বলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য সোমবার যুগান্তরকে বলেন, দলের মহাসচিব প্রায় শতকোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন। চাপের মুখে এখন অনেককে টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাসও দেয়া হচ্ছে।

ওই নেতা জানান, মূলত ব্যক্তিস্বার্থে দলকে বলি দিয়েছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। অথচ তিনি নিজের ও স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্নার আসন দুটি নিশ্চিত করতে ভোলেননি। প্রথমেই তিনি নিজের জন্য পটুয়াখালী-১ আসন এবং স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্নার জন্য বরিশাল-৬ আসন বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে।

কিন্তু বাস্তবতা হল, এ দুটি আসনই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এখানে নির্বাচিত হওয়ার মতো জনসমর্থন হাওলাদার এবং তার স্ত্রীর নেই। বিপরীতে গোপন সমঝোতা আর আর্থিক সুবিধা নিয়ে দলের ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়নবঞ্চিত করেছেন।

এ নিয়ে জাতীয় পার্টির কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। এ ক্ষোভ প্রকাশ্য রূপ নেয় রোববার। সোমবারও সেই ক্ষোভের আগুন আরও ফুঁসে ওঠে। নেতাকর্মীদের অভিযোগ- দলকে বিকিয়ে তিনি এভাবে নোংরা মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন।

এদিকে দলের মহাসচিবের মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে সাহসের সঙ্গে মুখ খুলেছেন জাতীয় মহিলা পার্টির সাধারণ সম্পাদক অনন্যা হোসাইন মৌসুমী। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু অর্থের বিনিময়ে এ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকার মনোনয়ন নিশ্চিত করেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে অনন্যা হোসাইন মৌসুমী ফেসবুকে পোস্ট দেন।
এতে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এই সময়ের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও পার্টির মহাসচিবের মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে অনেক ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।’

মৌসুমী আরও বলেন, ব্যক্তিস্বার্থে জাতীয় পার্টিকে বিক্রি করে দিয়েছেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। তার কারণে দল এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে। তিনি দ্রুত জাতীয় পার্টি থেকে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বহিষ্কারের দাবিও জানান।

সূত্র বলছে, শুধু অনন্যা হোসাইন মৌসুমী একা নন, মহাসচিবের মনোনয়ন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী। টাকা ফেরত না পেলে কেউ কেউ শিগগির তথ্য-প্রমাণসহ সব ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন।
এ ছাড়া রহুল আমিন হাওলাদারের এই মনোনয়ন বাণিজ্যের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত আছেন আরও কয়েকজন নেতা। যাদের মুখোশ শিগগির উন্মোচন করে দেবেন দলের ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা।

Post a Comment

Previous Post Next Post