'ইমপোর্টেন্ট বাট নট স্টেরাইল' - ডা. সাঈদ এনাম

'ইমপোটেন্ট বাট নট স্টেরাইল' -  ডা. সাঈদ এনাম

ডা. সাঈদ এনাম: স্যার আমার মাথার সব চুল পড়ে যাচ্ছে, এই দ্যাখেন দ্যাখেন.... বলে মহিলা তার মাথা টা একটু নিচু করে আমাকে দেখালেন।

আমি তাকাই, হ্যা কিছুটা মনে হলো আমার কাছে। নদীর বুকে জেগে উঠা চরের মতো মাথার তালুর কিছু কিছু অংশে চুল পড়ে সাদা চামড়া উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চেম্বারে এরকম অনেক রোগিই পাই যাদের মাথার চুল পড়া সমস্যা থাকে। তবে এটি রোগী র প্রধান কম্পলেইন থাকেনা। এই যেমন অন্যান্য দু একটি রোগ- মাথা ব্যথা, ঘুম কম হওয়া, অবসাদ লাগা,মেজাজ চড়া থাকা, মাথার তালু সব সময় গরম থাকা ইত্যাদি দুচারটে কমপ্লেইন বলার পর হয়তো এক ফাকে একটু বলেন, স্যার আমার মাথার চুল গুলোও কেমন জানি পড়ে যাচ্ছে ইদানিং। একটু দেখবেন। সেটি ব্যপারটি ভিন্ন।

আমি বললাম হুম, টুকটাক চুল সবারইতো পড়ে, এনিয়ে এতো ব্যতিব্যস্ত চিন্তিত হবার কিছু নেই। আপনার মুল সমস্যাটা কি..

স্যার এইটাই, চুল পড়া..। সব চুল পড়ে যাচ্ছে। এই সখিনা এদিকে আয়। ব্যাগ থেকে চুল গুলো বের করে স্যার কে দেখা...।

সখিনা হেল্পিং হ্যান্ড। ওকে সাথে করে নিয়ে এসছেন। সে একটা ব্যাগ থেকে দু হাত দিয়ে বের করলো বিশাল বড় চুলের বান্ডিল। মনে হচ্ছিলো আলগা চুলের খোপা। সুন্দর গুছালো। তেল মাখানো। যত্নে করে রেখেছেন।
দ্যাখেন দ্যাখেন গেলো দুদিনে আমার সব চুল পড়ে শেষ...।

এগুলো আপনার চুল...!?

জ্বী স্যার, আমার।

কদিনের জমানো?

বললাম'তো গেলো দুদিনের।

আমি সখিনার দিকে তাকিয়ে ঈশারায়

জিজ্ঞাস করলাম, সত্যি...?

জ্বী স্যার। সখিনা মাথা নেড়ে উত্তর দেয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম, বলছেন কি? আমার বিশ্বাস হয়না!! চুল পড়তে পারে। প্রতিদিনই মানুষ এর চুল পড়ে আবার নতুন চুল উঠে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে দুদিনে একেবারে অর্ধেক।

সাথে আসা মা বললেন, হ্যা, এরকম। ওর ছোট বেলা থেকেই মাথায় অনেক চুল। ওর চুল দেখার জন্যে আমার অনেক আত্মীয় স্বজন প্রায় আসতো। কিন্তু ইদানিং পড়ে যাচ্ছে সব। আগেও পড়তো। তবে কম। গেলো সপ্তাহ থেকে সব পড়ে দেখেন আমার মেয়েটির মাথাটায় একে বারে ঢাউস এক টাক। আমরা সবাই চিন্তিত দেশে কি বিদেশে....,আপনার বিশ্বাস নাহলে এই দেখুন, এই বলে তিনি একটি চিরুনি বের করে আমার সামনে মেয়েটির মাথায় হালকা একটা টান দিলেন।

আমি বললাম আহা করেন করেন কি করেন কি.....!

না স্যার আপনাকে দেখাই। আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা।

আমি দেখলাম, সত্যি চিরুনীতে বেশ কটি চুল লেগে আছে।

মহিলা বললেন সখিনা, নে এ চুল গুলোও তুলে রাখ। আমার মেয়ের অতি যত্নের চুল। খবরদার একটাও যেনো না পড়ে এথায় সেথায়, খেয়াল রাখিস।

একটু মুশকিলেই পড়লাম। এই চুল পড়া রোগিতো আমার কেইস না। যদি কমপ্লেইন হতো, রাগ হলে কিংবা মন খারাপ হলে নিজের চুল নিজেই টানে তাহলে বুঝতাম হয়তো ওসিডি বা ট্রাইকোটেলোমেনিয়া কেইস। বাট ইটস এটিপিক্যাল। তাই জিজ্ঞেস করলাম, আমার কাছে আপনাদের কে পাঠিয়েছে। মানে রেফারেল কাগজ বা কোন প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসেছেন সাথে...?

মেয়ে বললো, না আমাদের কোন ডাক্তার পাঠান নি। এমনি এসছি। আসলে আমার বড় ভাই এর বন্ধু এক কলেজের শিক্ষক। তিনি বললেন, সত্যি এতো চুল পড়ছে, ভীষন বিপদ। তোমরা বরং কোন ব্রেইনের ডাক্তারের কাছে যাও। ব্রেনের সমস্যা হলেও নাকি চুল পড়ে, তিনি নাকি শার্লোক হোমসের কোন এক গল্পে পড়েছেন এ নিয়ে। তাই আসলাম....।

এবার মেয়েটির মা যোগ করলেন, স্যার আমার মেয়ের অবশ্য আরেকটি ছোট সমস্যা আছে। ও অল্পতেই রেগে যায়। আর বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের ।

যেমন..?

যেমন ধরুন রান্না যদি ভালো না হয়, মুখে দিয়েই প্লেট ছুড়ে মারবে। খাবেনা। না খেয়ে থাকবে। এক দিন দুদিন। খুব রাগ করে। ছোট বেলা থেকেই। এখোনো আমাকে মুখে তুলে খাওয়াতে হয়। এতো বড় হয়েছে। বিয়ে হয়েছে, বাচ্ছা ও আছে।এখনো খাইয়ে দিতে হয়। খুব আহলাদে, ছোট মেয়েতো। কিন্তু কে যে যন্ত্রনায় আছি...।

সত্যি? মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম।

সে উত্তর দেয় না। স্যার আমার চুল পড়ার কি হবে? এটার চিকিৎসা দেন। মামনির কথা শুইনেন না। কি সব যে বলে মামনি। এই মা,তুমি থামোতো। নাইলে বাইরে গিয়ে বসোগা।

আপনি কি করেন..? মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম।

কিছুনা। আপাতত মামনির সাথেই থাকি। হাসবেন্ড আছেন। তিনি লন্ডন থাকেন। ছ'মাস পর পর আসেন। পনের বিশ দিন থাকেন আবার চলে যান। আমাদের একটি ছেলে একটি মেয়ে আছে। ছেলের বয়স সাত ও বাবার সাথে লন্ডনে মেয়ের পাঁচ বছর। এই যে আমার সাথে....,এই সুসানা, এদিকে আসোতো মা। ডক্টর আংকেল কে সালাম দাও।

সুসানা দৌড়ে আসে। আমার টেবিলের সামনে। আসসালামু আলাইকুম ডক্টর....।
হুম ওয়ালাইকুম সালাম.... সোহানা।

সুসানা, হয়নি। মা একটু ধমকের সুরে বলেন। তোমাকে কি শিখিয়েছি। যে ভাবে শিখিয়েছি ওইভাবে বলো, আসসালামু আলাইকুম, গুড এভিনিং এন্ড...ঐভাবে। ক'দিন পরইতো বাবার সাথে লন্ডনে সেটেল্ড হবা। এভাবে ভুল করলে চলবে....।

মিস্টি হেসে সুসানা বলে, অহ সরি সরি মাম, আসসালামু আলাইকুম গুড এভিনিং ডক্টর এন্ড হাও আর ইউ ডক্টর.....?

আমি বললাম ওকে ওকে, মামনি। হয়েছে। ভেড়ি স্মার্ট লিটল এঞ্জেল। আই এম ফাইন, মামনি তুমি যাও, গিয়ে বস।

আপনি কি চুলের খুব যত্ন করেন...?

হ্যা। আমি ছোট বেলা থেকেই চুলের যত্ন করি। আমার বয়স যখন সাত তখন থেকেই আমি চুলে কলপ দেই। জেল দেই।
বুঝলাম না....! সাত বছর বয়সে কলপ?

মেয়ের মা জবাব দিলেন, হ্যা স্যার। আমার মেয়ে চুলের প্রতি খুব যত্নশীল সেই ছোটবেলা থেকে। ওর ঘন চুল। কিন্তু সমস্যা ছিলো ও রোদের বের হলেই চুল সব লাল হয়ে যেতো। তাই তখন থেকেই সে চুলে কলপ দেয়। কালো কলপ। আমেরিকা থেকে ওর বাবার আনা। আমরা অবশ্য দেশি কলপ টলপ দেইনা। দেশি কলপ ভালোনা। মনে হয় পুরোনো আলকাতরা ছেঁকে বোতলে ভরে রেখেছে। কি পঁচা গন্ধ। আর একবার দিলে চুল কালো হয় ঠিক তবে সব চুল পড়ে মাথায় ইয়া বড় টাক বেরিয়ে যায়। তাই ওর জন্যে ওর বাবা আমেরিকা থেকে এক স্যুটকেস কলপ প্রতি বছর পাঠিয়ে দিতেন...।
অবশ্য আমার মেয়ে আরেকটি কথা বলে, কলপ দিলে নাকি তার মাথা ঠান্ডা থাকে, তার ভালো লাগে। সে জন্যেও অনেক সময় চুল লাল না হলেও মাথা ঠান্ডা থাকার জন্যে সে কলপ দেয় নিয়মিতো।

আমি খানিকটা কৌতূহল বোধ করলাম । মাঝে মাঝে জঠিল, মিক্সড কিছু কেইস হ্যান্ডেল করতে হয়। এটাও বুঝি সেরকম।

আচ্ছা আপনি বললেন গত দুদিনে আপনার সব চুল পড়ে গিয়ে এই হাল হয়েছে, তাহলে বলুনতো গত দুদিন আপনি কয় বার চুল আচড়িয়েছেন?

এই সখিনা এদিকে আয়তো, বলতো ক'বার হবে। তুইতো চুল আঁচড়াস।

স্যার শুধু গোসল আর খাবার দাবার ছাড়া, গত দুদিন সারাক্ষনই আঁচরানোতেই ছিলাম আমি...!! সখিনা উত্তর দেয়।

ঘুমের সময়ও...? আমি জিজ্ঞেস করলাম

জ্বি স্যার এমন কি ঘুমের সময় ও। আঁচড়ানো বন্ধ করলে তিনি ঘুম থেকে জেগে যান। আমাকে বলেন, তুই যাহ ঘুমাগা। জরিনা কে পাঠা। আমরা তিনজন আছি আপার চুলের বুয়া। আমাদের কাজ কেবল উনার চুল আঁচড়ে দেয়া।

আচ্ছা রাগ টাগ করলে কখনো কি চুল টানেন আপনি। মানে চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে হয়....?

মেয়েটি হেসে বললো, না স্যার আমি চুলে ভুলেও কখনো টান দেই না।

মা তাকে থামিয়ে বললেন, দেয় দেয় স্যার। সারাক্ষন চুলে হাত দেয়। আর টানে, দেখে চুল ঠিক আছে কিনা, শক্ত আছে কিন। অনেক সময় নিজে নিজে চুল তুলে আনে আনমনে।

অফ মামনি, তোমাকে না বলছি বাইরে যেতে, কম কথা বলতে। কি যে করোনা বাচ্চাদের মতো....!

স্যার আমি কেবল নরম চুল গুলো টেনে আনি। একটা চুল নরম হলে সেটা পাশের চুলটাকে নরম করে ফেলে। একটা চুল লাল হলে পাশের টাও লাল হয়। আমি ইন্টারনেটে পড়েছি।

আমি মনে মনে খুশি যাক একটা ক্লু অবশেষে পেলাম। আমি সেদিক না গিয়ে এসোসিয়েটেড কিছু আছে কিনা দেখতে প্রসংগ চেঞ্জ করে বললাম,
আচ্ছা। বুঝলাম। আমাকে একটি ব্যাপার বলেনতো, আপনার কি ভুলপড়ার বাতিক আছে, এই যেমন চাবি কোথায় রাখলেন ভুলে যান বা, ব্যাগ কোথায় রাখলেন ভুলে যান, কিংবা পার্লারে গেছেন আসার সময় দেখলেন ওড়নামেন্টস ব্যাগ টাই ফেলে এসেছেন...?আবার ফিরে যান সেটি আনতে?

জ্বি জ্বি এগুলো হয়, তবে মাঝে মাঝে।সব সময় না....।

কোন কাজ কি বার বার করেন? যেমন ধরেন মোবাইল ব্যাগে নিয়েছেন,তারপর ও মনে হলো মোবাইল নিয়েছেন কিনা আবার ব্যাগ খুলে চেক করলেন। কিছুক্ষন পর আবার চেক করলেন...? ঘরের সিটকিনি লাগিয়েছেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পর মনে হলো লাগান নি, আবার চেক করলেন। গাড়ির দরজা লক করেছেন তার পরও মনে হলো লক করেন নি। আবার যান চেক করে আসেন?

হ্যা স্যার এরকম হয়। তবে সমস্যা হয়না। এটা ঠিক চাবি কোথায় রাখি সেটা প্রায়ই ভুলে যাই। এজন্যে আমার সাথে কাজের মেয়ে রহিমা কে রাখি। রহিমা আমার চাবীর বুয়া।ও আছে বাইরে দাঁড়িয়ে, ডাকবো?

না থাক।

মাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কি বাথরুমে বেশি কাটায়।

মা চিন্তা করে বললেন, হ্যা মাঝে মাঝে।

সে কি খুব পারফেকশনিস্ট? মানে কোন জিনিষ যাতে নিঁখুত ভাবে হয় এই ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন থাকে। এই যেমন বার বার হাত ধোয়া, কাপড় ধুয়া। বিছানা মুছা।

হ্যা, স্যার। খুব জেদি।যেটা বলেছে যেভাবে বলেছে ওভাবে তার হওয়া চাই ই চাই। একটা কাপড় সে বার বার দাঁড়িয়ে থেকে বুয়া দিয়ে ধুয়াবে। সাবান দুতিনটি তো প্রতিদিন ই লাগে।

মেয়ে এবার তার মাকে একটু ঝারি দিয়ে বলে, আম্মু কি বলছো এসব। আমি কি অরকম করি। না স্যার। আমি এরকম কিছু করিনা। তবে সবাইতো একটু আধটু নিখুঁত হতে চায়। সুন্দর থাকতে চায়।

আচ্চা আপনার হাসবেন্ড এর ব্যাপারে কিছু বলুন।

হাসবেন্ড...,তিনি খুব ভালো মানুষ। জেন্টলম্যান। একেবারে সাদাসিধে। আমার ব্যাপারে খু কেয়ারী। যা চাই তাই দেন। আমার সব চাহিদাই তিনি পুরন করেন লন্ডনে থেকে। সেদিন আমার জন্যে এই ফোনটি পাঠালেন। আমার অনেক ফোন আছে। তারপরো পাঠালেন। ফোন টির দাম শুনলাম দেড় লক্ষ টাকা। আমিতো বকা ঝকা করলাম উনাকে। তবে খুশি হয়েছি। আমার ছ'জন বুয়া। সব গুলোকে মোবাইল দিয়েছি। এগুলো আমার ছিলো। অদের দিয়েছি। ওরাতো গরিব, কিন্তু ওদেরও'তো শখ আহ্লাদ আছে।

ওরা ইন্টারনেট ফেসবুক সব জানে। অদের সব গুলার ফেইসবুক একাউন্ট আছে।আমি ই শিখিয়েছি। দুটি কাজের মেয়ে একটু বদ আছে আবার। ফেইসবুকে চার হাজার বয় ফ্রেন্ড বানিয়েছে। প্রেমের চ্যাট করে ডজন ডজন ছেলের সাথে। শিক্ষিত ছেলে, প্রবাসী ছেলে, বিবাহিত আই বুড়ো ও আছে দু একটা। আমার কাছ থেকে ইংরেজীতে শব্দ জেনে নিয়ে চ্যাটিং করে। "আই গুড, ইউ গুড" এই টাইপের। আমার হাসি পায়।

যাহোক আমিও ব্যবহার করি। কখনো কখনো সারারত করি। তবে আমি বেশি মোভি আর সিরিয়াল দেখি। আমার হাসবেন্ড ও বলে দিয়েছেন। সময় কাটবে, ইন্টারনেট ঘাটবে,পড়বে। তবে আমার হাসবেন্ডের একটি সমস্যা আছে। উনি আমার চেয়ে বয়সে পার ট্রিপল। এই যা।

এক বিয়ের অনুস্টানে উনার সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি তখন ইংলিশ অনার্সের ছাত্রী। উনাকে কেনো জানি আমার ভালো লেগে যায়। আমাকেও ভালো লাগে তার। ব্যাস। ধুমধামে করে বিয়ে হয়। হেলিকপ্টার করে বর কনে আনা নেওয়া করা হয়। আমাদের খুব মজা লাগে। তবে ছোট সমস্যা আছে, শপিং এ গেলে দোকানী রা উনাকে বলে আংকেল আমাকে বলে মামনি, এই যা হি হি হি।

এটা শুনে চেম্বারে আমরা কেউই হাসি আটকাতে পারলাম না।

স্যার ওসব পুরোনো কথা বাদ । আমার চুল পড়ার কি হবে। প্লিজ আপনি কেবল আমাকে নিয়ে গল্পই করে যাচ্ছেন। আমি চলে যাবো। আমার চুল পড়ার ওষুধ দেন। আপনি না পারলে বলেন, আমি কাল পরশুই সিংগাপুর যাবো, গত রাতে আমার হাসবেন্ড কে বলেছি। তিনিও বলেছেন সিংগাপুর চলে যেতে। অথবা লন্ডন উনার কাছে যেতে। তবে লন্ডন যাবোনা।

আমি বললাম অবশ্যই। আমি আপনার চুল পড়া একদম বন্ধ হবার মেডিসিন দেবো। আর দুটো কথা বলেনতো।

কি বলেন?

ঘুম কেমন হয়...।

ভালো।তবে মাঝে মাঝে সারারাত জাগি। একা থাকিতো। মেয়েটাকে নানীর কাছেই রাখি। বিশাল প্যালেস আমাদের। আমার স্বামী ই আমাকে বিয়ের পর বানিয়ে দিয়েছেন। "মনিহার মহল"। কোটি টাকা খরচ করে বানানো। কিন্তু একা থাকিতো। মাঝেমধ্যে ভালো লাগেনা। বাড়ি ভর্তি খালি কাজের মেয়ে রেখে দিয়েছেন তিনি। পুরুষ বলতে দারোয়ান দুটো আর ড্রাইভার। তবে আমি ড্রাইভিং পারি। বাড়ির ভিতর ড্রাইভিং করি।

হাতে আপনার কিসের দাগ এটি...।

কই?

ঐ যে, মনে হচ্ছে কাটার।

মেয়েটি আড়াল করতে চাইলো। কিন্তু আর করলো না।

স্যার কেটে গিয়েছে।

কিভাবে?

এমনি...

এমনি কাটে?

আমিই কেটেছি..!!

কেনো?

যখন মন খারাপ লাগে, তখন কাটি।

ব্যাথা লাগেনা?

না। যখন মন খারাপ থাকে ব্লেড দিয়ে কাটি, টের পাইনা। কেবল ই কাটতে থাকি। তখন ভালো লাগে। মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু মন ভালো হবার পর সমস্যা হয়। কাটা স্থানে প্রচন্ড ব্যথা হয় জ্বালা যন্ত্রনা হয়। ওষুধ লাগাই। আম্মু লাগিয়ে দেন। আমি দেখলাম পাশে মেয়েটির মা চোখের জ্বল মুছছে।

স্বামীর সাথে লন্ডন যান না। যেতে বা থাকতে ইচ্ছা হয় না।

না যাইনা। বিদেশ ভালো লাগেনা।

বিদেশ ভালো লাগেনা?

হ্যা..লাগেনা।

কেনো?

এমনি..

এমনি কেনো? তার কি কোন রোগ আছে। শারিরিক দুর্বলতা আছে,এই যেমন ডায়বেটিস, প্রেশার। বা চড়া মেজাজ অথবা অন্য কিছু?

মেয়েটি দাত দিয়ে ঠোট চেপে রাখলো কিছুক্ষন, তারপর বললো,জ্বি স্যার, উনার সবই আছে। ডায়াবেটিস, প্রেশার, বাইপাস অপারেশন, গল ব্লাডার অপারেশন,প্রোস্টেট সব। সাতটি অপারেশন নিয়ে লোকটি বেঁচে আছে। কিন্তু খুব ভালো মানুষ। আমি খুব সুখি। খুব...। ছেলে মেয়ে নিয়ে আমি খুব সুখি। অতি নরম কচ্ছপ স্বভাবের মানুষ তিনি। আমার একটু মন খারাপ হলেই তিনি লন্ডন থেকে চলে আসেন। সেজন্যে আমি মন খারাপ করিনা। ভুলেও করিনা। পাছে চলে আসেন।

কথাগুলো বলার সময় তার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।

আর কিছু...?
না..।

রিয়েলি... আই থিংক ইউ আর হাইডিং সামথিং...!?

ইয়েস স্যার, ইউ আর রাইট। হি ইজ উইক, "হি ইজ ইম্পোটেন্ট বাট নট আন স্টেরাইল....!!!!", কিন্তু আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে সব মেনে নিয়েছি।

আমি মনে হলো যেনো অন্ধকারে একটা আলোর দেখা পাচ্ছি....।

রোগ টি ক্রিটিক্যাল। মানসিক রোগ গুলা জটিল। সব ব্রেইনের নিউরো ট্রান্সমিটার এর সিক্রেশনে উলট পালট হওয়াতে হয়। একটা বেশি তো একটা কম। ডোপামিন আর সেরোটোনিন। আবার কখনো সব গুলোই বেশি।

যাক গে, মেয়েটির চুলের ব্যাপার টি ক্লিয়ার হচ্ছেনা আমার কাছে। এতো চুল দুদিনে কিভাবে পড়লো। বিশাল এক খোপা হবে চুল গুলো দিয়ে। কিছুটা ট্র‍্যাইকোটিলোমেনিয়ার মতো। ট্র‍্যাইকোটিলোমেনিয়া একটা মানসিক রোগ। এরোগে রোগী নিজের চুল নিজেই টেনে ছিড়ে ফেলে। এতে তার এনজাইটি দূর হয়। ভালো লাগে। কখনো সজ্ঞানে করে, কখনো অবেচেতন মনে করে।

অনেক সময় বসে বসে টিভি দেখতেছে ওদিকে চুল টানতেছেও। ব্রেইনের এম আর আই করলে দেখা যায় এ ধরনের রোগীর ব্রেইনের গ্রে মেটার এর বলিউম কম ।

ট্রাইকোটিলোমেনিয়া সম্পর্কে সর্ব প্রথম ধারনা দেন এরিস্টটল। এ ধরনের রোগী আমি পেয়েছি আগে। তবে খুব কম। এরা আই ব্রু, আই ল্যাশ এমন কি হাতের লোম ও তুলে ফেলে, খুমটে খুমটে, টেনে টেনে।
অবশ্য অনেক সময় ওসিডি (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসওর্ডার) এর পেশেন্ট ও চুল টেনে টেনে চুল তুলে ছিড়ে। বা অনেক সময় চুল কাটতে থাকে। একবার এক তরুণী পেয়েছিলাম যে কিনা বাথরুমে গিয়ে তার সব চুল কেটে ফেলেছিলো। তার এই অদ্ভুত কাজে ভয় পেয়ে এবং কিছুটা বিরক্ত হয়ে তার বাবা ধরে নিয়ে এসেছিলেন হাসপাতালে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, চুল কেনো কেটে ফেললে। সে বললো, স্টাইল ফলো করার জন্যে। স্টাইল টি ফলো করে নিজেই কাটছিলাম একটু একটু করে। হচ্ছিলো না...। তাই বার বার কাটছিলাম, তার পর একবার আয়নায় খেয়াল করলাম, আরে,সব চুল কেটে এবড়ো থেবড়ো... ।

ওভার পারফেকশনিস্ট হতে যেয়ে এই অবস্থা হয় এধরনের পেশেন্ট দের।

ওসিডি বা অবসেসিব কম্পালসিভ ডিসিজের রোগীরা অভার পারফেকশনিস্ট হয়। এরা এক চিন্তা বার বার করে,এক কাজ বার বার করে। ঘুমের সময় বার বার ঘরের ছিটিকিনি লাগিয়েছে কিনা চেক করে। কলম, চাবি ফেলে এসেছে কিনা, বার বার ব্যাগ খুলে চেক করে। ওসিডি'র পেশেন্টেদের ব্রেইনের কডেট নিউক্লিয়াস এ প্রবলেম দেখা যায়।

কিন্ত এই আজকের এইট পেশেন্ট টা আমার কাছে কিছুটা কমপ্লিকেটেড আর মিক্সড মনে হচ্ছে। এ ধরনের আরেক টি রোগী পেয়েছিলাম যে ছিলো মুলত কনভারসন ডিসওর্ডার এর রোগী।


প্রেসেন্টেশন ছিলো ডিপ্রেশন নিয়ে। স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। উনারা ছিলেন ইউ এস এর নাগরিক। স্ত্রী হটাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে যেতেন। বিশেষ করে রাতের বেলা যখন তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যেতেন। আর সব সময় মন মরা থাকতেন। শারিরীক মেলামেশায় আনন্দ পেতেন না। নিজেকে আড়াল করতেন সবকিছুতে।

অদ্ভুত লাগে আমার কাছে কেইসটা। বেশ কয়েকটি সাইকোথেরাপি সেশন দেবার পর তার কনভার্সন ডিসওর্ডার এর কনফ্লিক্ট টি বের করি। আমি হতভম্ব হয়ে যাই!! তার ফ্রিজিডিটির কারন জেনে।
"আই ওয়াজ মলেস্টিং বা মাই এল্ডার ব্রাদার.......!!!! "

মেয়েটি তার সৎ ভাইয়ের মাধ্যমে রাতের পর রাত সেক্সুয়েল এব্যুজের স্বীকার হয়েছে, তার বয়স যখন ছিলো আট সেই সময় থেকে।

আমি বললাম আপনি মা বাবা কাউকে শেয়ার করেননি কেনো বিষয়টা । সে বললো, প্রথম প্রথম বুঝতাম না। ধীরে ধীরে যখন বয়স বাড়তে থাকে তখন বুঝি । কিন্তু আমি আর লজ্জায় কাউকে বলতে পারতাম না। তাছাড়া কেউ জানলে বড় ধরনের অসুবিধা হতো। পুলিশ এসে ভাইকে ধরে নিয়ে যেতো। পুরো পরিবারের উপর ও সবার একটা নেতিবাচক ধারনা জন্মাতো।
তাই এক সময় আমি কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। খালার বাড়ি থাকতে শুরু করি। সেখানে থেকে ই আমার এই হাসবেন্ডে "ওয়াকার" এর সাথে পরিচয় হয়।

আমি জিজ্ঞেস করি আপনার হাসবেন্ড ওয়াকার কে কি ঘঠনা গুলো বলেছিলেন। তিনি বললেন হ্যা। সে প্রথমে আমার ফেইস বুক ফ্রেন্ড ছিলো। আমাদের চার বছরের বন্ধুত্ব। আমার মন খারাপ কারন জিজ্ঞেস করলে এক সময় তার সাথে আমি সব শেয়ার করি। ওয়াকার খুব ভালো ছেলে।বন্ধুর মতো বুঝাতো। মুলত তার কাউনসেলিং এ আমি এই স্ট্রেস থেকে রিলিভ পাই। সে আমাকে বুঝায় এগুলো খুব যে আন কমন তা নয়। আমি বাঁচার স্বপ্ন দেখি তার ভালোবাসায়, তার হাত ধরে নতুন জীবন পাই। পরে আমরা বিয়ে করি।

আমি বলি, হ্যা আপনার স্বামী ঠিকই বলেছেন। নিকট আত্মীয়দের মাধ্যেমে অল্প বয়সে যৌন নিগ্রহ খুব যে আন কমন তা নয়। আমাদের দেশেও যায়। কেউ বলে না লজ্জা শরমে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার ভাই কি আপনাকে ভালোবাসতো। তিনি বললেন না। সেটি ভেবে দেখেন নি কখনো।

আমি তাকে আমেরিকার বিখ্যাত নায়ক লেখক পরিচালক মারলন ব্রান্ড এর ফ্যামিলির কাহিনী বলি। ব্রান্ডো সে সময় দুর্দন্ড প্রতাপশালী জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন। চার্লি চ্যাপলিন, ম্যারেলিন মনরো এর পরেই ছিলো তার জনপ্রিয়তা। খ্রীশ্চান ও চেয়েনে ছিলো ব্রান্ডের ছেলে ও মেয়ে। সমস্যা হয়ে যায় খ্রীশ্চান তার বোন চেয়েনিকে ভালো বাসতো। সেই ভালোবাসার এমন যে, এর জন্য খ্রীশ্চান এক সময় চেয়েনির বয় ফ্রেন্ড কে প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে হত্যা করে।

আদালতে খ্রীশ্চানের দশ বছরের জেল হয়। তার মৃত্যু দন্ড হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু চেয়েনি তার আপন ভাই বলে খ্রীশ্চান কে মৃত্যু দন্ড থেকে এই বলে বাঁচিয়ে দেন যে, হত্যা কান্ডটি ছিলো দুর্ঘটনাবশত। কারন চেয়েনির বয় ফ্রেন্ড চেয়েনিকে যৌননির্যাতন করছিলো আর তার ভাই সে সময় উপস্তিত হয়ে তাকে রক্ষা করতে যেয়ে হত্যা কান্ডটি ঘটায়। চেয়েনি আপন ভাই কে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে মিথ্যের আশ্রয় নেন।
তিনি মাথা নেড়ে বলেন আমি ঘটনাটি জানি।

আমি বললাম আপনার সমস্যাটা তো দীর্ঘ দিনের। আমেরকায় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান নি খেন ? আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্টরা আপনাকে কাউনসেলিং করেনি এ ব্যাপারে?

তিনি বললেন দেখিয়েছি। আমি আমার ডিপ্রেশন, ফ্রাস্ট্রেশন, ফ্রিজিডিটি সব বললেও আমার ভাইয়ের মলেস্টিং কথাটা সবসময় এভয়েড করতেম। বলতাম না। বললে ভয় হতো আমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। সেখানের আইন খুব কড়া। আর হাজার হোক সেতো আমার ভাই। আর তাই হয়তো আমার রোগের প্রোপার কাউন্সেলিং হতোনা। তারা কেবল আমাকে ট্রানকুইলাইজার আর প্রপানোলল জাতীয় ওষুধ দিতো।
তাহলে এখন বললেন যে...আমি বললাম। তিনি বললেন, আপনিতো আর আমার ভাইকে আর পুলিশে দেবার ব্যবস্থা করবেন না।

যাক গে সে ঘটনা। চুল পড়া রুগীকে নিয়ে আমার অনেক কিছু জানার ছিলো। কিন্তু সময় কম থাকায় আর চেম্বারে রগি থাকায় তাকে বললাম, আপনাকে সিংগাপুর যেতে হবে না, লন্ডন যেতে হবে না। আপনি এক কাজ করুন আগামি সপ্তাহে আসুন। আমার আরো কিছু জানার আছে। আর মাথায় এক সপ্তাহ চুলে কলপ দেয়া বন্ধ রাখবেন এমন কি চুলে হাত টি পর্যন্ত দিবেন না। জাস্ট প্রয়োজনে দু একবার হয়তো আঁচড়া বেন।
পাশে থাকা মেয়েটির চুলের পরিচর্যাকারী কেও বলে দিলাম খবর দার, মনে থাকে যেনো।



- ডা. সাঈদ এনাম
এমবিবিএস (ডি এম সি,কে ৫২) 
এম ফিল (সাইকিয়াট্রি) সাইকিয়াট্রিস্ট এন্ড নিউরোলজিস্ট। 
ইউ এইচ এন্ড এফ পি ও, সিলেট।

Post a Comment

Previous Post Next Post