অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
স্টাফ রিপোর্টারঃ দেশের অন্যতম বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রকৃতি আর সৌন্দর্য যেখানে মিলেমিশে একাকার।

দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গবেষক ও পরিবেশবিদদের কাছেও জ্ঞানের আধার হিসেবে বিবেচিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ ছবির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই বনে। সেই লাউয়াছড়া দিনে দিনে ধ্বংসের পথে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অব্যবস্থাপনা আর অবহেলাকে এজন্য দায়ী করছেন প্রকৃতিপ্রেমী ও বিশেষজ্ঞরা। এ উদ্যানে রয়েছে বিরল প্রজাতির বৃক্ষ। রয়েছে কমপক্ষে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ ও ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ২৪৬ প্রজাতির পাখি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, প্রভাবশালীদের বন দখল, অবাধে বৃক্ষনিধন, অবৈধ করাতকল স্থাপন, বনের ভিতর রেল-সড়ক পথ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রক্ষণাবেক্ষণে অসচেতনতাই এই বনের আয়তন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বন্যপ্রাণী আইনে বলা আছে সরকার প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য বা পরিবেশগত গুরুত্ব বিবেচনা করে কোনো সরকারি বন, বনের অংশ বা যে কোনো নির্দিষ্ট এলাকাকে বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের নিমিত্তে সুনির্দিষ্টভাবে সীমানা নির্ধারণপূর্বক অভয়ারণ্য ঘোষণা করতে পারবে। কিন্তু ভানুগাছের সংরক্ষিত বনের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হলেও বনের কোর জোন, বিনোদন জোন ও বাফাজোন সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি। তাই কোর জোন, বিনোদন জোন ও বাফাজোন একাকার হয়ে পুরো বন এলাকা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর তখন থেকেই ধ্বংস শুরু হয়। দর্শনার্থীরা অবাধে বনের ভিতর প্রবেশ করতে শুরু করে। বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দর্শনার্থীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। আর এ সুযোগে শুধু দর্শনার্থীরাই নয়, একসময় যে বনে গাছ চোররা রাতের আঁধারে লুকিয়ে যেত, সেই বনে তারা প্রকাশ্যই দিনের বেলায় প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায়।

বর্তমানে ফি দিয়ে যে কেউ লাউয়াছড়া বনে প্রবেশ করতে পারেন। এতে করে অনেকটা ফ্রি স্ট্রাইলে গাছ চোররা দিনের বেলায় তাদের সুবিধাজনক স্থান চিহ্নিত করে ভালো গাছটি দেখা আসতে পারছে। আর রাতের আঁধারে তা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। একই পন্থা অবলম্বন করছে বন্যপ্রাণী শিকারিরাও। ২০০৫ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন বিভাগের সঙ্গে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প তাদের কাজ শুরু করে। সীমানা চিহ্নিত না করেই নিসর্গ বনের ভিতর তাদের উন্নয়ন কাজ শুরু করে। আশপাশের লোকজনকে সংগঠিত করে গঠন করে ইকোট্যুর গাইড।

পর্যটকদের সুবিধার্থে বনের ভিতরে ব্রিজ, কালভার্ট, ওয়াসরুম, পিকনিকস্পর্ট, পায়ে চলার ট্রেইল, দোকান স্থাপন করে। আর বন রক্ষার নামে যারা চিহ্নিত গাছ চোর ছিল তাদের দিয়ে গঠন করে দেয় বন টহল বাহিনী। বর্তমানে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে সহব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্বাবধানে লাউয়াছড়ার প্রবেশ পথে দৃষ্টিনন্দন গেট ‘শতাব্দী স্মারক’ স্থাপন করা হচ্ছে। আর গেটের পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার। গাড়ি রাখার স্থান ও বিভিন্ন দোকান। আর এসব দোকান থেকে প্রতি মাসে ভাড়া আদায় করছে কমিটি।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জন দেব বলেন, জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর থেকে লাউয়াছড়ায় যত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হয়েছে তার সবই বন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ফি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ লোক বনে প্রবেশ করছে। যা বনের প্রাণীদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক বছরে লাউয়াছড়ায় প্রবেশ করেছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬ জন লোক। এই বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী বনে অবাধে বিচরণ করায় বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, হারাচ্ছে তাদের নির্ঝঞ্ঝাট আবাসস্থল। বনের ভিতর দর্শনার্থীদের ফেলে রাখা চিপস, বিস্কুট আর চানাচুরের প্যাকেট পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বশীল এক বন কর্মকর্তা বলেন, টিকিট কেটে মানুষ প্রবেশ করিয়ে আমরা নিজেরাই লাউয়াছড়া ধ্বংস করছি। বন আইনে লাউয়াছড়া একটি সংরক্ষিত বন। বনের কোর জোনে মানুষ প্রবেশ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু ১৯৯৬ সালে বনের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় উদ্যানে শিক্ষা, গবেষণা, ইকোটু্যুরিজমের জন্য অনুমতি সাপেক্ষে মানুষ প্রবেশ করতে পারবে। এখন আমরা কোন আইন প্রয়োগ করব।

এদিকে, বিলুপ্তির পথে বনের ৪০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪১ প্রজাতির পাখি, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ আর আট প্রজাতির উভচর প্রাণী। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভিতর বন গবেষণা কেন্দ্রটিও মৃত। বন উন্নয়নে কোনো গবেষণামূলক কার্যক্রম নেই। অলস সময় পার করছেন বন গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে প্রতিনিয়ত শিকার করা হচ্ছে বন্যপ্রাণী, উজাড় করা হচ্ছে বনাঞ্চল, দখল হয়েছে বনভূমি। বনের এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্য রয়েছে ১৩/১৪টি সমিল। বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও  বনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না কর্তৃপক্ষ।

লাউয়াছড়া বনের বিট কর্মকর্তা মো. আনায়ার হোসেন বলেন, লাউয়াছড়াকে রক্ষা করতে হলে সংরক্ষিত বনের কোনো জোন থেকে বিনোদন জোন আলাদা করে দিতে হবে এবং জাতীয় উদ্যানে সীমিত সংখ্যক লোকের প্রবেশাধিকার দিতে হবে। মানুষের চিৎকার হৈহুল্লোড়ে বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বিঘ্ন ঘটছে বন্যপ্রাণীদের মিলন, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি।

প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, প্রতিবেশগত ভিন্নতাকে গুরুত্ব না দিয়ে বনবিভাগ একাশিয়া-ইউক্যালিপটাসের মতো আগ্রাসী বাণিজ্যিক বাগান গড়ে তুলেছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দে বলেন, লাউয়াছড়া বনের কোর জোন, বিনোদন জোন বা বাফা জোনের সীমানা চিহ্নিত হয়নি এটা ঠিক। তবে দর্শনার্থীদের জন্য বন্যপ্রাণীদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আর যেহেতু এটা ন্যাশনাল পার্ক দর্শনার্থীরা প্রবেশ করবেই।

Post a Comment

Previous Post Next Post