ইমাদ উদ দীনঃ
চলতি (ভাসমান) চুলা। ঘরের স্থায়ী চুলাতে জ্বালানো যাচ্ছেনা আগুন। এ কারনে
এমন অভিনব চুলার উদ্ভাবন। এখন হাওর পাড়ের বন্যা কবলিত প্রতিটি বাড়িতে
রান্নাবান্নার ভরসা ‘চলতি চুলা’। টিন দিয়ে তৈরী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে
বহন করার এচুলার কদর এখন বন্যা কবলিত হাওর এলাকায়।
বন্যায়
দূভোগগ্রস্থরা জানালেন এবারকার বন্যা অন্যবারের চাইতে একটু ভিন্ন। এবারের
বন্যা দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় রুপ নিয়েছে। মাসের পর মাস। কমছেনা বানের পানি।
চৈত্রের অকাল বন্যার পর এ পর্যন্ত ৩য় দফা বন্যা। এবছর বন্যা শুরু থেকে এখন
পর্যন্ত পানি বেড়েই চলেছে। ৩য় দফা বন্যার মাসদিন অতিবাহিত হলেও বানের পানির
অবস্থা রয়েছে অপরিবর্তিত। এক দু’ফুট পানি কমলেও বৃষ্টিতে আবার যেই সেই।
বাড়ি ও ঘরে পানি। রাস্তাঘাট, টিবওয়েল, টয়লেটও ডুবিয়ে দিয়েছে বানের পানি।
ঘরের ভেতর আর রান্না ঘরে এখন জবর দখল পানির। এমন বেহাল অবস্থায় হাওর পাড়ের
অনেকেই ইতিমধ্যে তাদের বসত ভিটা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র। নিজের আত্মীয়
স্বজন কিংবা আশ্রয় কেন্দ্রে। কিন্তু কোথাও সমস্যা তাদের পিছু ছাড়ছেনা।
সেখানেও বিশুদ্ধ খাবার পানি,রান্নাবান্না আর টয়লেটের সমস্যা প্রকট।
এবছর
প্রাকৃতিক দূর্যোগ তাদের পিছু নিয়েছে। একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগে
তারা বির্পযস্ত। চৈত্রের অকাল বন্যায় তাদের স্বপ্নের সোনালী ফসল বোরো ধান
হারায়। ওই বন্যায়ই ধান পঁচা বিষক্রিয়ায় মারা যায় মাছ,হাঁস,জলজ প্রাণী ও
উদ্ভিদ। এরপর ২য় ও ৩য় দফার চলমান বন্যায় তাদের ঘরবাড়িতে পানি উঠে। ডুবিয়ে
দেয় তাদের ক্ষেত কৃষি (সবজি) আর বসত ভিটা। সব হারিয়ে হাওর পাড়ের বাসিন্ধারা
হয়ে পড়েন নি:স্ব। নিজ ঘরে থাকার জায়গা নেই। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের
নিশ্চয়তা নেই। এখন হাওর জুড়ে শুধুই হাহাকার। দিন দিন এই হাহাকার বেড়েই
চলেছে। চারদিকে থৈ থৈ পানি। তাই কর্মহীন হাওর পাড়ের অসহায় হতদরিদ্র মানুষ।
পরিবার পরিজন নিয়ে খাওয়া বাচাঁর চিন্তায় তারা দিশেহারা।
সরজমিনে
হাকালুকি হাওর পাড়ের বেলাগাঁও,শাহপুর, জালালপুর,কাইয়ারচর, শশারকান্দি
দেখিয়ার পুর, বেড়কুড়ি, মদনগৌরি, সাদিপুর, উত্তর সাদিপুর, গৌড়করনসহ কয়েকটি
গ্রামে গেলে দেখা মিলে বানভাসি মানুষের দূর্ভোগের দৃশ্য। পানিবন্দি
অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে তারা নানা কষ্টে দিন যাপন করছেন। তাদের গৃহপালিত
পুশুও বানের পানিতে রয়েছে বন্দি। গো খাদ্য সংকটে এখন তাদেরও হাড্ডিসার দেহ।
জালালপুর গ্রামের সুহেল মিয়া ও সাজনা বেগম জানালেন চলমান বন্যার সাথে এখন
আফাল ও বলনে (বড় ঢেউ)তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দিচ্ছে। ঘরের ভেতরেও পানি থাকায়
তারা ‘চলতি চুলা’ (ভাসমান) চুলায় কোন রকম রান্নাবাড়ার কাজ সারছেন। আব্দুর
রহমান ও আছিয়া বেগম জানালেন বার বার বন্যায় আমাদের সব কেড়ে নিচ্ছে। খেয়ে না
খেয়ে এতদিন নিজের ঘর বাড়িতে ছিলেন। এখন এই ভাঙ্গা ঘরবাড়িতে হয়ত আর থাকতে
পারেবেন না। পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে তারা চরম মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। একই
গ্রামের আব্দস শহিদ ও রোকেয়া বেগম জানান তাদের ৫ ছেলে মেয়ে সবাই লেখাপড়া
করে।
এবছর
বোরো ধান হারানোর পর তাদের সব স্বপ্নের মুত্যু ঘটেছে। এখন কোন রকম
অর্ধহারে অনাহারে দিন যাপন করছেন। তারা জানালেন বিশুদ্ধ পানি আর
রান্নাবান্নার জন্য তারা সমস্যায় পড়েছেন। চলতি চুলায় রান্নার কাজ কোনরকম
সারা গেলেও জ্বালানি কাটের সমস্যা প্রকট। তাছাড়া ওই চুলায় বড় বাসন দিয়ে
রান্না করা যায়না। তাই সবদিক দিয়ে তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। আর বাড়ি ও
ঘরেতে যে পানি ডুকেছে তা শরীরে লাগলে চুলকায়। বিশুদ্ধ পানি না থাকায় তারা
ওই বানের পানিই খাচ্ছেন। এজন্য তাদের পেট ব্যাথা, ডাইরিয়া, চরমরোগসহ নানা
রোগবালাই এখন তাদের নিত্য সঙ্গীহয়ে পিছু নিয়েছে। সাদিপুর গ্রামের লয়েছ মিয়া
ও শাফিয়া বেগম জানান বন্যার পর থেকে নানা দূর্ভোগ আমাদের সঙ্গী হয়েছে।
রান্নার
জন্য চলতি চুলায় ভরসা পেলেও এখন মারাত্মক সমস্যা টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির।
টিবওয়েল গুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আমরা বিপাকে পড়েছি। তাই বানের পানি আমারা
কলসে ভরে ‘রড’ গরম করে তাতে ডুকিয়ে দিয়ে বিশুদ্ধ করে সেই পানি আমরা খাই।
তারা জানালেন ‘রড’ গরম করে এরকম পানি বিশুদ্ধ করার অভিনব পদ্ধতি তারা নিজেই
আবিস্কার করেছেন। এ অঞ্চলের তাদের পূর্বসূরীরা নাকি বন্যার সময় টিবওয়েল
পানিতে ডুবে গেলে এরকম পানি বিশুদ্ধ করতেন। সেই পুরানো পদ্ধতি এখন বলবৎ
রেখেছেন তারা। উত্তর সাদিপুর গ্রামের মিশিল মিয়া জানালেন তার পরিবারের লোক
সংখ্যা ১০ জন। তার পেশা হচ্ছে কৃষি আর মাছ ধরা। কিন্তু এবছর সব হীতে
বিপরীত। চৈত্রের অকাল বন্যায় যেমন ধান খেয়েছে। তেমনি ভাসমান পানিতে এখন
মাছও ধরা পড়ছে কম। তারপর ঘরে খানি নেই। জ্বালানি নেই। বিশুদ্ধ পানিও নেই।
এবছরের বন্যা তাদের সব কেড়ে নিয়ে চরম অসহায় করে দিয়েছে। জালালপুর গ্রামের
নামর আলী জানালেন সরকারী সহয়তা আমাদের কপালে জুটেনা। দোকানবাকী খেয়ে কোন
রকম জীবন রক্ষা করছি। বানের পানি না কমলে আফাল আর বলনের কবল থেকে ঘরবাড়িও
রক্ষা করা যাবেনা। ঘরে পানি থাকায় এখন চলতি চুলাই আমাদের রান্নাবান্নার
একমাত্র ভরসা।