অনলাইন ডেস্কঃ
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৮৯তম জন্মদিন আজ। ১৯২৯ সালের এই দিনে অবিভক্ত
বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জাহানারা ইমাম।
মুক্তিযোদ্ধার
গর্বিত মা, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সংগঠক এই মহীয়সী নারীর নেতৃত্বেই গত শতকের
নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন। একাত্তরের ঘাতক
দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে করা সেই আন্দোলনই আজ এগিয়ে যাচ্ছে চূড়ান্ত
পরিণতির দিকে। চলছে মানবতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের
কাজ। ইতোমধ্যে এই ঘৃণ্য অপরাধীদের অনেকেরই ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে।
একাত্তরে
একই সঙ্গে স্বামী ও সন্তানকে হারিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
জাহানারা ইমামের পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
তাঁর ১৯ বছর বয়সী বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমি আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার
সুযোগ ত্যাগ করে দেশের ডাকে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে
পড়েন। প্রিয়জনকে হারানোর সেই বেদনা তাঁর ভেতর জ্বেলে দিয়েছিল দ্রোহের আগুন।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তাঁর নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের মাধ্যমে একাত্তরের
শীর্ষ নরঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। এরপর আমৃত্যু এই
সংগ্রামী নারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন।
বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে
নিবেদিত করেন। যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারে আনার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা
ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ সময়ের ডায়রি ‘একাত্তরের দিনগুলি’
তাঁর এক অনন্য সৃষ্টি।
১৯৯১
সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের
দলের আমির ঘোষণা করলে দেশের জনগণ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। জামায়াতের
এই ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ৭০টি রাজনৈতিক,
সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ২১ জানুয়ারি গড়ে ওঠে
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। পরবর্তীতে আরও বিস্তৃত কলেবরে ১১
ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল
নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত
হন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
মুক্তিযুদ্ধে
স্বামী ও সন্তানহারা, দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত শহীদ জননী
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আযম এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে
তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে জনগণের আকাঙ্ক্ষায় ১৯৯২
সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে ঐতিহাসিক গণআদালত। শহীদ
জননীর সভাপতিত্বে লাখ লাখ বিচারপ্রার্থীর উপস্থিতিতে ঘাতকদের হোতা গোলাম
আযমের প্রতীকী বিচার হয়। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত নির্দিষ্ট ১০টি অভিযোগের
প্রত্যেকটিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা
হয়।
১৯২৯
সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জাহানারা
ইমাম জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলীর
তত্ত্বাবধানে তিনি রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা শুরু করেন। স্বামী
প্রকৌশলী শরীফ ইমামও তাঁকে লেখাপড়ায় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার
লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বিএড পাস করার পর তিনি ঢাকা
ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন। তাঁর
কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে।
১৯৫২
থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা
ছিলেন। এর পর ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে তিনি আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে
১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৮ সালে
তা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেন। একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধে ছেলে রুমী ও স্বামীকে হারান। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাঁর
কেটেছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের মধ্য দিয়ে। এ সময় তার মনের মধ্যে ছিল
দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। এ দুঃসময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য
করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের এসব বৃত্তান্ত তিনি দিনলিপি আকারে নানা চিরকুটে,
ছিন্ন পাতায় ও গোপন সংকেতে লিখে রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের এ দিনলিপি ১৯৮৬
সালে একাত্তরের দিনগুলি নামে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক
মর্মস্পর্শী এ বৃত্তান্ত জনমনে ব্যাপক সাড়া জাগায়।
স্বাধীনতার
পর জাহানারা ইমাম লেখালেখি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময়
কাটান। মুক্তিযুদ্ধে ছেলে রুমীর আত্মত্যাগ এবং নিজের অবদানের কারণে সবার
কাছে আখ্যায়িত হন শহীদ জননী হিসেবে। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন দুরারোগ্য ব্যাধি
ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েট
শহরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
একজন
সুসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন জাহানারা ইমাম। তাঁর লেখা ‘একাত্তরের
দিনগুলি‘ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল। তাঁর লিখিত অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে
অন্য জীবন, বীরশ্রেষ্ঠ, জীবন মৃত্যু, চিরায়ত সাহিত্য, বুকের ভিতরে আগুন,
নাটকের অবসান, দুই মেরু, নিঃসঙ্গ পাইন, নয় এ মধুর খেলা, ক্যান্সারের সঙ্গে
বসবাস ও প্রবাসের দিনলিপি।