আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে


অনলাইন ডেস্ক:  একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় নয় মাস ধরে পাক হানাদার ও তাদের দেশীয় দোসররা বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আগে দেশের ভেতরেই জাতীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে জনগনের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। 

রাজধানীর বসুন্ধরায় দৈনিক কালেকণ্ঠের কার্যালয়ে “গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই মতামত ব্যাক্ত করেন আলোচকরা। এসময় বক্তারা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এবং জাতীয়ভাবে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নানা পরামর্শও দেন। 

দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় আজ শনিবার (০১ এপ্রিল ২০১৭) এই গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দৈনিক কালেরকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল বৈঠকের সুচনা বক্তব্যে আলোচ্য বিষয়ের উপস্থাপনা করেন। 

এরপর বৈঠকে একে একে বক্তব্য রাখেন, ড. নুজহাত চৌধুরী, শহীদ পরিবারের সন্তান, আসিফ মুনীর, শহীদ পরিবারের সন্তান, এ কে এম আতিকুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব, শাহীন রেজা নূর, নির্বাহী সম্পাদক, ইত্তেফাক, শহীদ পরিবারের সন্তান, ডা. ফাউজিয়া মোসলেম, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, গোলাম কুদ্দুস সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ডা. এম এ হাসান, আহবায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, শাহরিয়ার কবির, নির্বাহী সভাপতি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, হারুণ হাবিব, মহাসচিব সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, ডা. সারোয়ার আলী, ট্রাস্টি, মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘর, ড. করুণাময় গোস্বামী, শিক্ষাবিদ। 

বক্তারা বলেন, জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করায় এখন ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে আমাদেরকে এখন প্রধানত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়েই কাজ করতে হবে। কারণ এখন ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানালে এতে বরং জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হতে পারে। 

সুতরাং আমাদের মূল প্রচেষ্টাটা হওয়া উচিৎ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় নিয়ে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ৯/১১-কে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করার আহবান জানিয়েছে। সূতরাং গণহত্যা দিবস আদায় নয় বরং গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ই হওয়া উচিত আমাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। 

এছাড়া বাংলাদেশ সরকারও মাত্র চলতি বছর থেকেই ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন করছে। এর আগে কখনও জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হয়নি। যে কারণে আর্মেনিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বরকেই আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়। অথচ আর্মেনিয়ার গণহত্যায় মাত্র ৮ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশের গণহত্যায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়। 

বক্তারা বলেন, ২৫ মার্চে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ খোদ বাংলাদেশেই জাতীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে সকল মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাব আছে। যে কারণে শুধু আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস নয় বরং এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলছে না। 

বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে জাতীয় অসচেতনতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাধা-বিপত্তিও দায়ী। পাকিস্তান তো এর বিরোধীতা করেই পাশাপাশি তথাকথিত বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ পশ্চিম ইউরোপের কতিপয় দেশও পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সকল দলিলপত্রেও এখনো ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক বিজয় হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। 

বক্তারা বলেন, একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে হলে আগে দেশের ভেতরে বিষয়টি নিয়ে জাতীয়ভাবে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে দৈনিক কালেরকণ্ঠ সহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যমগুলোকে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানোর আহবান জানান তারা। বিশেষ করে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার বধ্যভুমি সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিবেদন এবং গণহত্যা সংশ্লিষ্ট মানবিক গল্প প্রকাশ করে গণমাধ্যমগুলো এই ভুমিকা পালন করতে পারে। 

এছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এ বিষয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। বিশেষত একাত্তরের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত দেশীয় অপরাধীদের পাশাপাশি পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
 বাংলাদেশে গণহত্যায় সরাসরি জড়িত পাকিস্তানি সেনা সদ্যস্যরাসহ গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকশ্রেনীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ইয়াহহিয়া, ভুট্টোসহ জড়িত অন্যান্যদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। অন্তত প্রতীকিভাবে হলেও এদের বিচার করে সাজা ঘোষণা করতে হবে। তাহলেই বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টনক নড়বে। 

প্রসঙ্গত, একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিচার প্রথম দাবি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে দেশে ফেরার পথে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর লন্ডনে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে এবং এর বিচার অবশ্যই হতে হবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post