শুভ্র দেব: সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া করেন মো. রাজু
উদ্দিন। ছোট ভাইদের নিয়ে তেজকুনিপাড়ার ৬২/এ, হোন্ডার গলির একটি বাসার মেসে
থাকেন। চারতলা ওই বাড়ির নিচতলা ও ২য় তলায় মেস ভাড়া দেয়া হয়েছে। গত দুই বছর
ধরে তিনি এই বাসায় ভাড়া থাকেন। এখন তিনি বের হয়েছেন নতুন বাসা খুঁজতে। কারণ
জানতে চাইলে তিনি অনেকটা অভিযোগ করে বলেন, আমরা ব্যাচেলর। তাই আমাদের কাছ
থেকে বাড়ি ভাড়া নেয়া হয় ২২ হাজার টাকা। এর বাইরে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ
অন্যান্য বিল দিতে হয়। আর যারা পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়
১৫ হাজার টাকা। আবার আমাদের জন্য অনেক শর্তাবলীও আছে। রাত ১১টার মধ্যে
বাসায় ফিরতে হবে। সময়মতো ভাড়া দিতে হবে। তিন রুমের বাসায় ৭-৮ জনের বেশি
থাকা যাবে না। তিনি বলেন, আমরা লেখাপড়া করি। বাড়ি থেকে আমাদের সীমিত টাকা
দেয়া হয়। এই টাকা দিয়েই আমাদের সারা মাসের থাকা, খাওয়া, ইউনিভার্সিটির খরচ,
হাত খরচ- সব চালিয়ে নিতে হয়। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া
হয় বিধায় আমরা সব খরচ চালাতে হিমশিম খাই। তাই মেসের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত
নিয়েছি আমরা আর এই বাসায় থাকবো না। কয়েকদিন ধরে বাসা পরিবর্তন করার জন্য
অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করছি। বিজ্ঞাপন দেখে রাজাবাজারের কয়েকটি বাসায় ফোন
করেছি। ব্যাচেলর শুনে আর ভাড়া দিতে চান না। অনেক বাড়ির মালিক আবার প্রশ্ন
করেন কতজন থাকবো, সবাই কি করে। বেশি লোক থাকবে কিনা। আবার যেসব বাড়ির
মালিকরা ভাড়া দিতে চান তারা ছোট ছোট দুই রুমের ফ্ল্যাট ১৫-১৬ হাজার টাকা
ভাড়া চান, যা আমাদের জন্য সম্ভবপর না। মাস শেষ হয়ে গেছে। আগের বাসাও ভাড়া
হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমরা এখন কোথায় গিয়ে উঠবো। লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি
বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন নাজনিন এশা। গত কিছুদিন ধরেই বাসা খোঁজাখুঁজি
করছেন। আগের বাসায় অতিরিক্ত ভাড়া । তার ওপর মেয়ে ব্যাচেলার হিসেবে থাকতে
হলে নানান শর্তাবলী মেনে চলতে হয়। এসব ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে তিনি এখন
বাসা পরিবর্তন করবেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি বাসায় যোগাযোগও করেছেন। কিন্তু কোথাও
সুবিধামতো হচ্ছে না। সমস্যা একটাই। আর তা হচ্ছে ব্যাচেলার সমস্যা। যেখানেই
যোগাযোগ করছেন সেখানে শুধু ব্যাচেলর বিড়ম্বনা। তিনিও বাড়ির মালিকদের প্রতি
অনেকটা ক্ষোভ করে বলেন। কাঁঠালবাগানের একজন বাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ
করলে তিনি বলেন, সাবলেটে থাকতে হলে মাঝারি সাইজের দু’টি রুম আছে। একটি রুম
১২ হাজার আর একটি আছে ১০ হাজার টাকা। তবে দু’জনের বেশি থাকা যাবে না।
নাজনিন এশা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, যেখানে দুই রুমের ফ্ল্যাট পাওয়া যায়
১২ হাজার টাকায় সেখানে সাবলেটে এক রুমের ভাড়া দিতে হবে ১২ হাজার টাকা। একই
সমস্যায় আছেন আল মোস্তফা গ্রুপে কর্মরত রাকিব মজুমদার। তিনি গত দুই মাস আগে
চাকরিতে যোগদান করেছেন। এতদিন ফুফুর বাসায় ছিলেন। এখন আলাদা কোনো জায়গায়
থাকতে চান। পুরো জানুয়ারি মাস ধরে বাসা খোঁজে এখনও সুবিধামতো বাসা পাননি।
রাকিব বলেন, এক মাস ধরে তিলপাপাড়া, খিলগাঁও, বাসাবো, তালতলা গোড়ান,
সিপাহিবাগসহ আশপাশের সব জায়গায় প্রায় ২শ’ বাসা দেখেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত
কোথাও বাসার ব্যবস্থা করতে পারি নেই। কিছু কিছু বাড়ির মালিক ব্যাচেলার
শুনেই কিছু না বলে লাইন কেটে দেন। এমনকি মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন
অনেকে। আমার রুমে আরো কয়েকজন বড় ভাই আছেন। তারাও বাসা খুঁজছেন। শুধু মো.
রাজু উদ্দিন, নাজনিন এশা আর রাকিব মজুমদার নন ঢাকা শহরে এরকম কয়েক লাখ
ব্যাচেলার আছেন যারা আবাসন সংকটে ভুগছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক
ব্যাচেলার জানান পুরো ঢাকা শহরে আমাদের জন্য এই সমস্যাটা প্রকট হয়ে
দাঁড়িয়েছে। দোষ করে কিছু মানুষ আর তার জন্য ভোক্তভোগী হতে হয় সবাইকে। একটু
ভালো বাসায় থাকলে চাইলেও উপায় নেই। বেশি ভাড়াও দিতে হয় আবার অনেক সময় বেশি
ভাড়া দিয়েও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে ও ভাড়াটিয়া পরিষদ সূত্রে
জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এমন সব শিক্ষার্থীর
মধ্যে ১০-১৫ শতাংশের স্থান হয় বিভিন্ন হোস্টেল ও হলগুলোতে। বাকি ৮৫-৯০
শতাংশ শিক্ষার্থী বাধ্য হন বাইরে বাসাভাড়া করে থাকতে। সে হিসাবে রাজধানীর
শিক্ষার্থী ভাড়াটিয়ার সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি। আর বিভিন্ন
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্টানে কাজ করেন এমন ব্যাচেলরদের সংখ্যা প্রায় ১০
লাখ। এ ছাড়া রয়েছেন গার্মেন্টকর্মীদের একটি বিশাল অংশ। এদের সংখ্যা ৫-৬ লাখ
হবে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা এবং রাজধানীর কল্যাণপুরের জাহাজ
বাড়িতে জঙ্গিদের আস্তানায় পুলিশি হামলার কারণে আর কোনো ব্যাচেলরকে বাসাভাড়া
দিতে নারাজ মলিকরা। সে সঙ্গে যেসব বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে ব্যাচেলরা
অবস্থান করছেন, তাদেরও বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছেন বাড়ির মালিকরা। তাই নতুন
করে বাসাভাড়া না দেয়া ও বাসা ছাড়ার নির্দেশে দিশাহারা রাজধানীর প্রায় ২৫-৩০
লাখ ব্যাচেলর। আর এই ব্যাচেলারদের আবাসন সমস্যাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির
অসাধু বাড়ির মালিকরা লাভবান হচ্ছেন। বছরে একবার ভাড়া বাড়ানোর কথা থাকলেও
কারণে অকারণে বছরে দুইবার তিনবার ভাড়া বৃদ্ধি করা হয় বলে অনেকেই অভিযোগ
করেন। আবার ফ্যামেলি বাসার চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া হয়। গতকাল পশ্চিম
তেজতুরি বাজারের ২৩/এফ-৫ নম্বর বাসায় যোগাযোগ করা হলে বাড়ির মালিক জানান,
ছোট সাইজের একটি রুম খালি আছে। তবে ভাড়া হবে ৮ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গ্যাস,
বিদ্যুৎ বিল, ফ্রিজ চালালে ফ্রিজের বিলও দিতে হবে। তিনজন থাকলে আরো বেশি
ভাড়া পড়বে। ব্যাচেলরদের কেন ভাড়া দিতে চান না এ বিষয়ে একাধিক বাড়ির মালিকের
সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, দেশে জঙ্গি হামলা এবং কিছু মেসে জঙ্গিরা
আস্তানা গড়ার কারণে বাড়ির মালিকরা ভয়ের মধ্যে আছেন। আবার কেউ কেউ বলেন,
ব্যাচেলর ভাড়া দিলে অন্যান্য ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে যারা থাকেন তারা নানা
অভিযোগ করেন। তারা বেপরোয়া চলাফেরা করেন। তাদের মধ্যে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা
থাকে না। ব্যাচেলরদের বাড়ির মালিকরা বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। তেজতুরি
বাজারের ১৭ গোল্ডেন পার্কের সুপার ভাইজার মো. আশরাফ বলেন, আমরা ব্যাচেলার
ভাড়া দেই না। কারণ এই বাসায় সবাই পরিবার নিয়ে থাকে। প্রতিটি পরিবারেই
মেয়েরা আছে। ব্যাচেলারের ভাড়া দিলে অনেক সময় নানান ঝামেলা হয়। তবে
ব্যাচেলারদের বাসা ভাড়া দেয়া নিয়ে পুলিশের কোনো বিধিনিষেধ নেই। শুধু
ভাড়াটিয়ার সঠিক তথ্য নিয়ে বাসা ভাড়া দেয়া যাবে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র
নিশ্চিত করেছে।